সেখ মুদাসসির নিয়াজ
গুজরাত: বিজেপি – ১৫৬ / কংগ্রেস – ১৭ / আপ – ৫ / অন্যান্য – ৪
হিমাচল: কংগ্রেস – ৪০ / বিজেপি – ২৫ / অন্যান্য – ৩
দিল্লি পুরভোট: আপ – ১৩৪ / বিজেপি – ১০৪ / কংগ্রেস – ৯ / অন্যান্য – ৩
হিমাচলে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় ফিরল কংগ্রেস। দিল্লি পুরভোটে ঝাড়ু ঝড়ে সাফ পদ্ম। একইসঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা ও লোকসভা উপনির্বাচনেও বড় ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। এই দফায় গেরুয়া শিবিরের সান্ত্বনা পুরষ্কার কেবল গুজরাত। হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরি হিসেবে পরিচিত গুজরাতের ফলাফল নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। প্রায় তিন দশকের প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া, মোরবি সেতু দুর্ঘটনা, বিলকিসের ধর্ষকদের মুক্তি, লাগামহীন দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, উন্নয়ন মডেলের মিথ্যা ফানুস – কোনকিছুই কাজে এল না গুজরাতে। হিন্দুত্বের জিগির, জাতীয়তাবাদ, প্রবল মেরুকরণ ও বিভাজন অস্ত্রেই কংগ্রেস বিরোধী শিবিরকে দুরমুশ করল বিজেপি। আগের সব রেকর্ড, এমনকী স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির রেকর্ডও ভেঙে এবার রকেট গতিতে ছুটল বিজেপির জয়রথ। বিপুল জনাদেশ নিয়ে ১৫৬ আসন পেয়ে সপ্তমবারের জন্য ওই রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখল ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার। গতবারের থেকে ৫৭টা বেশি পেল বিজেপি।
গত ২৭ বছরে এই প্রথমবার এত ভাল ফলাফল করল বিজেপি। ২০১৭ সালের ফলাফলের ধারেকাছেও এবার পৌঁছতে পারল না কংগ্রেস। এবার তারা গতবারের ৬০ আসন খুইয়ে সাকুল্যে পেয়েছে মাত্র ১৭ আসন। তথৈবচ অবস্থা কেজরিওয়ালেরও। মাত্র ৫ টা আসন নিয়ে সান্ত্বনা পুরষ্কার জুটেছে অনেক হম্বিতম্বি করা কেজরিওয়ালের। তবে তাদের মিশন সাকসেসফুল। কারণ কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে বড় রকমের থাবা বসিয়ে ভোট কাটাকুটিকর খেলায় বিজেপিকে হেলায় জিতিয়ে দিতে পেরেছে আপ। তবে গুজরাতে কংগ্রেসের ক্ষতে প্রলেব দিয়েছে হিমাচল প্রদেশ। এই পার্বত্য রাজ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজেপির সরকারকে গোহারা করেছে কংগ্রেস।
বলা বাহুল্য, গুজরাটে এর আগে মাত্র একবারই এত আসনে জয় পেয়েছিল কোনও দল। ১৯৮৫ সালে মাধব সিংহ সোলাঙ্কির নেতৃত্বে গুজরাটে কংগ্রেস পেয়েছিল ১৪৯ আসন। আপাতত এটাই সর্বোচ্চ রেকর্ড। কিন্তু এবার ৩৭ বছর আগের কংগ্রেসের সেই রেকর্ড ভেঙে ৩২ বছর ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হল বিজেপি। দাঙ্গার পরপরই ২০০২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে প্রবল গেরুয়া ঝড়ে ১২৭ আসন গিয়েছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঝুলিতে। সেটাই ছিল মোদির নেতৃত্বে গুজরাতে সবথেকে ভাল পারফর্ম্যান্স। এবার সেই রেকর্ডও ভেঙে ফেলল পদ্ম শিবির। কার্যত এবার গেরুয়া সুনামিতে ভেসে গেল অতীতের সব রেকর্ড।
আগের পাঁচবারের মধ্যে ২০১৭ সালেই সবথেকে কম আসন পেয়েছিল বিজেপি। ম্যাজিক ফিগার ৯২ থেকে মাত্র ৭টি আসন বেশি পেয়েছিল তারা। সেবার বিজেপিকে কড়া টক্কর দিয়ে কংগ্রেস পেয়েছিল ৭৮ আসন। এবার তারা এক ধাক্কায় অধিকাংশ জেতা আসন খুইয়ে বসল। টানা ২৭ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়াকে নিজেদের পালে টানতে ব্যর্থ হল কংগ্রেস। মোরবি সেতু দুর্ঘটনাও বিজেপির ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলতেই পারল না। বরং গেরুয়া সুনামিতে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল কংগ্রেস সহ বিরোধী শিবির। তবে কংগ্রেসের প্রাপ্তি বলতে শেষ পর্যন্ত আপকে পেছনে ফেলে শতাব্দী প্রাচীন দলটি কোনক্রমে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে।
প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ বিজেপির শীর্ষ নেতাদের লাগাতার প্রচার, বিজেপি শাসিত ১৭ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, ২০ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গুজরাতের মাটি কামড়ে পড়ে থেকে প্রচার চালানো, প্যাটেল জাতির লোককে শেষমেষ মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানো, হার্দিক প্যাটেল সহ পাতিদার নেতাদের দলে টানা এবং সর্বোপরি ধর্মীয় মেরুকরণ ও বিভাজন বিজেপিকে এই ঐতিহাসিক জয় এনে দিল। এবার গুজরাতে কংগ্রেস গাছাড়া ভাব দেখিয়ে কার্যত বিজেপিকে ওয়াকওভার দিয়ে দিল। এতবড় প্রেস্টিজ ফাইটকে কংগ্রেস এতটাই লঘুভাবে নিয়েছিল যে, তাদের স্টার ক্যাম্পেইনার রাহুল গান্ধি গতবার গুজরাত চষে বেড়ালেও এবার নাম কা ওয়াস্তে খান তিনেক মাত্র প্রচার করেন। গুজরাতে ভোট চলাকালে তিনি মূলত ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে দেশজুড়ে পদযাত্রা করছিলেন। অন্তত নির্বাচনের এই সময়টা তিনি ওই পদযাত্রা না করলেই পারতেন।
অন্যদিকে হিমাচলে জিতেও ঘোড়া কেনাবেচার আশঙ্কায় কংগ্রেস তাদের জয়ী বিধায়কদের নিরাপদ গন্তব্য রাজস্থানে নিয়ে চলে গেছে। এই রাজ্যে ২০১৭ সালের তুলনায় বিজেপি ১৯ আসনে পিছিয়ে। ৬৮ আসনের মধ্যে ৪০টা পেয়েছে কংগ্রেস, বিজেপির রথ ২৫-এই থেমে গেছে।
এত ভাল ফল করলেও কিন্তু অপারেশন লোটাস-আতঙ্ক কংগ্রেসের পিছু ছাড়ছে না। তাদের ভয় হল, মোটা টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া হতে পারে নবনির্বাচিত বিধায়কদের। এই আতঙ্কেই কংগ্রেস তাদের জয়ী প্রার্থীদের জয়পুরে নিয়ে চলে গেছে। সেখানে হোটেলে একরকম গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে বিজেতাদের। মাত্র কয়েকমাস আগে মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরে সরকার ভাঙানোর আগে শিবসৈনিক বিধায়কদের প্রথমে গোয়া ও তারপর অসমে নিয়ে চলে যায় বিজেপি। একইভাবে এবার হিমাচল প্রদেশে রিস্ক নিতে চাইছে না কংগ্রেস।
গুজরাতের মতোই এখানেও প্রথমবার ভোটে লড়েছিল আম আদমি পার্টি। তবে এখানেও আপের চিঁড়ে ভেজেনি। উল্লেখ্য, কেরলের মতোই হিমাচলে নির্বাচনের ইতিহাসেও গত চার দশকে কোনও সরকার পর পর দুবার ক্ষমতায় ফেরেনি। হিমাচলে ২০১৭ সালে ৪৪ আসনে জিতেছিল বিজেপি। কংগ্রেস পেয়েছিল ২১ আসন। হিমাচলে প্রতি ৫ বছর অন্তর অন্তর সরকার বদলের ইতিহাস রয়েছে। বিজেপি দাবি করেছিল এবার তারা সেই রেকর্ড ভাঙবে। কিন্তু তা করতে নাড্ডা ব্রিগেড ব্যর্থ হল। আবার বিভিন্ন রাজ্যে উপনির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে যোগীরাজ্যে ভরাডুবি, হার রাজস্থান-ওড়িশাতেও! গুজরাট ছাড়া বাকি সব রাজ্যেই মুখ পুড়েছে বিজেপির।
উপসংহারে বলতে হয়, নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের নেতৃত্ব বিজেপি দল যা মন থেকে বিশ্বাস করে, তা চাঁচাছোলা ভাষায় চোখে চোখ রেখে বলে এবং সগর্বে ও সদর্পে সেই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে মরিয়া প্রয়াস চালায়। গত সাড়ে আট বছরে কেন্দ্রে মোদি সরকার সবথেকে যেসব উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে সেগুলো হল কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ, নোটবন্দি, তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ। ২০২৪ এর আগে করবে ইউনিফর্ম সিভিল কোড, সিএএ এবং হিন্দুরাষ্ট্র। এসবই কিন্তু খুব স্পর্শকাতর বিষয়। তাই বাজপেয়ী সরকার এসব ইস্যুতে খুব বেশি এগনোর সাহস করেনি। বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লালকৃষ্ণ আদবানি রথযাত্রা করে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক টেম্পো তুলে পরবর্তীতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করতে সক্ষম হলেও মোদি-শাহের মতো সংঘ পরিবারের মৌলিক অ্যাজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তাই বাজপেয়ী-আদবানি জুটির থেকে বহু যোজন এগিয়ে রয়েছে মোদি-শাহের বিজেপি। বাজপেয়ি সরকার পোখরান করেছিলেন, কার্গিল যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ৩৭০, তিন তালাক, এনআরসি-সিএএ, অভিন্ন দেওয়ানী বিধি, নোটবন্দি কিংবা হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার পথে সেভাবে এগোতে চননি। তবে এর নেপথ্য কারণ ছিল মিলিজুলি সরকার। মোদি সরকার কিন্তু একক সংখ্যাগরীষ্ঠ। তাই তারা কারো পরোয়া করছে না।
আর অন্যদিকে কংগ্রেস অন্তর থেকে যেটা বিশ্বাস করে, মুখে যা বলে এবং কাজে যা করে – তাতে খুব বেশি মিল পাওয়া যায়নি। বাবরি মসজিদ ভাঙার কথা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি, এটা তাদের দলীয় ম্যানিফেস্টোর কোথাও উল্লেখ নেই। অথচ নরসিমা রাও এর কংগ্রেস সরকারের আমলেই ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ওই ঐতিহাসিক মসজিদ ধ্বংসযজ্ঞ চললেও কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল। আবার রাজীব গান্ধীর আমলে শাহবানু মামলা এবং সর্বোপরি বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়া হয়েছিল। এসব থেকে এটা স্পষ্ট যে, কংগ্রেসের ত্রিচারিতা দেশবাসী এখন আর কোনমতেই মানতে পারছে না। গুজরাতে কংগ্রেস এবার সেভাবে বড় মিটিং, মিছিল, সভা, সমিতি করেনি বললেই চলে। তারা নেতারা দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোলে বা অনলাইনে ক্যাম্পেইন চালিয়েছে বেশি। বিজেপির মতো মাটি কামড়ে না থেকে কংগ্রেসী নেতারা জল মাপছিলেন। তাই তাদের নীতি যেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের। অগত্যা, যেমন কর্ম তেমন ফল। এই প্রবাদ খণ্ডাবে কার সাধ্যি?