বয়স মাত্র ২৩। এর মধ্যেই দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কিলিয়ন এমবাপ্পে। বিশ্বকাপে তার গোলের সংখ্যা ৯। রাশিয়া ও কাতার বিশ্বকাপ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১২টি ম্যাচ খেলেছেন। এবারের বিশ্বকাপে পাঁচটি গোল করে সোনার বুটের দৌড়েও এগিয়ে রয়েছেন ফ্রান্সের স্ট্রাইকার। অনবদ্য পারফরম্যান্সে লিয়োনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন এমবাপ্পে।
বিশ্বকাপে গোল সংখ্যার নিরিখে নিজের দেশের থিয়েরি ওঁরি বা জিনেদিন জিদানকে আগেই ছাপিয়ে গিয়েছেন এমবাপ্পে। ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগে বিশ্বকাপে সব থেকে বেশি গোল করার পেলের নজির ছুঁয়েছেন তিনি। সাধারণভাবে বিভিন্ন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের মধ্যে তুলনা করা কঠিন। প্রতিপক্ষ, সতীর্থ, খেলার কৌশল, নিয়ম, প্রযুক্তি অনেক কিছুই বদলে যায়। স্বাভাবিকভাবেই বদলে যায় সেরা বেছে নেয়ার নিক্তিও। পরিসংখ্যান বিচার্য হলে গত মে মাসেই দুই তারকা মেসি, রোনালদোকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন এমবাপ্পে।
২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর ২৩ বছর পূর্ণ করেছেন এমবাপ্পে। এই বয়সে গোল করার নিরিখে পর্তুগাল অধিনায়কের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। পেশাদার ফুটবলে রোনালদোর গোল সংখ্যা ছিল ১৩২টি। মেসি এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। প্যারিস সঁ জারমঁর দুই সতীর্থের ২৩ বছর পূর্ণ হওয়ার দিনে গোল সংখ্যা ছিল ১৯৭। আরো একটি পরিসংখ্যানে মেসি, রোনালদো দু’জনকেই পিছনে ফেলে দিয়েছেন এমবাপ্পে। ২৩ বছর বয়সের এমবাপ্পে ১১১ বার সতীর্থদের গোল করতে সাহায্য করেছেন। এই সংখ্যা মেসি এবং রোনালদোর ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৮৪ এবং ৬৬।
এমবাপ্পে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে। এমবাপের ঝুলিতে ১৪টি ট্রফি। ২৩ বছর বয়সে মেসি ১২টি এবং রোনালদো পাঁচটি ট্রফি জিতেছিলেন। দেশের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রেও এই দু’জনের থেকে পিছিয়ে নেই এমবাপে। ২৩ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে এমবাপ্পে ফ্রান্সের হয়ে ৫৩টি ম্যাচ খেলেছেন। সম সংখ্যক ম্যাচ খেলেছিলেন রোনালদো। এ ক্ষেত্রে আবার কিছুটা পিছিয়ে মেসি। তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেছিলেন ৪৯টি ম্যাচ। মাত্র ১৭ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলে হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্ব রয়েছে এমবাপ্পের। যা নেই মেসি বা রোনালদোর।
একাধিক পরিসংখ্যানে ২৩ বছরের এমবাপ্পে পিছনে ফেলে দিয়েছেন ২৩ বছরের মেসি এবং রোনালদোকে। প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই তিনি কারও থেকে পিছিয়ে নেই। শেষ পর্যন্ত একজন খেলোয়াড়ের শ্রেষ্ঠত্বের বিচার হয় সাফল্যের পরিসংখ্যান দিয়েই। খেলোয়াড়ের দক্ষতা, শিল্প গুরুত্বপূর্ণ হলেও শেষ কথা বলে সাফল্যই। সে দিক থেকেও মেসি, রোনালদোর থেকে এগিয়ে রয়েছেন এমবাপ্পে। রোনালদো পর্তুগালকে ইউরো জিতিয়েছেন। মেসি আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন করেছেন, বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছেন। যদিও বিশ্বকাপ দিতে পারেননি। এমবাপ্পে ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ দিয়েছেন। কাতারে চ্যাম্পিয়ন হলে দ্বিতীয়বার ট্রফি দেবেন।
পরিসংখ্যান এমবাপ্পের হয়ে কথা বললেও তাকে এগিয়ে রাখতে নারাজ প্রাক্তন ফুটবলার সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তার বক্তব্য, ‘এমবাপে নিঃসন্দেহে বড় ফুটবলার। রোনালদোর থেকে কিছুটা এগিয়ে। কিন্তু মেসি অন্য জাতের খেলোয়াড়। এমবাপে কেন, যেকোনো ফুটবলারের পক্ষেই মেসির ধারে কাছে পৌঁছানো কঠিন। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের প্রথম সারিতে থাকবে মেসি। ক্রীড়া নৈপুণ্যেও অনেক এগিয়ে। মেসির সাথে এমবাপ্পের কোনো তুলনা হয় না। আরো কয়েক বছর পর বলা যাবে মেসির কতটা কাছাকাছি পৌঁছতে পারবে এমবাপ্পে। আগামী দিনে অবশ্য এমবাপ্পেই ফুটবল দুনিয়াকে শাসন করবে।’
প্রাক্তন ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাস আবার এমবাপ্পেকেই এগিয়ে রাখছেন। তিনি বলছেন, ‘মেসি, রোনালদো নিঃসন্দেহে বড় ফুটবলার। এমবাপ্পেও পিছিয়ে নেই। শেষ পর্যন্ত সাফল্যই সব। এমবাপ্পে দেশকে বিশ্বকাপ দিয়েছেন। মেসি, রোনালদোরা দেশকে কোপা আমেরিকা বা ইউরো জেতালেও বিশ্বকাপ দিতে পারেননি। এমবাপ্পের বয়স কম। আরো একটা বা দুটি বিশ্বকাপ অবশ্যই খেলবেন। এখনই পরিসংখ্যানে এগিয়ে গিয়েছেন। আরো এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। পেলের মতো কিংবদন্তিও বলেছেন, এমবাপ্পে তার রেকর্ড ছুঁতে পারেন।’
সাফল্যই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হওয়া উচিত। সাফল্য না থাকলে দক্ষতা গুরুত্বহীন। তুলনায় কম দক্ষতা সাফল্য আনলে তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলোর ইতিহাস পরাজিতদের মনে রাখে না। চ্যাম্পিয়নদের কদর সেখানে। বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই সব রকমভাবে চেষ্টা করেও ঠোঁট এবং চায়ের কাপের দূরত্ব ঘোচাতে পারেন না। যারা পারেন তারাই সেরা বলে বিবেচিত হন। ২৩ বছরের এমবাপ্পে একাধিক ক্ষেত্রে তা করে দেখিয়েছেন।
মেসি, রোনালদোর সাফল্য যেকোনো ফুটবলারের কাছেই ঈর্ষণীয়। তারা ফুটবল জীবনের শেষ পর্যায়। এমবাপ্পে রয়েছেন শুরুর দিকে। এই নিক্তিতে তাকে মাপার সময় হয়তো আসেনি। এখন অন্তত এক দশক ক্লাব ফুটবল খেলবেন এমবাপ্পে। নিশ্চিত ভাবেই খেলবেন আন্তর্জাতিক ফুটবলও। তার অর্জন করার জন্য পড়ে রয়েছে গোটা ফুটবল দুনিয়া। এমবাপ্পে যে গতিতে এগোচ্ছেন তাতে আরো বহু রেকর্ড তার পায়ে চলে আসতে পারে। এখনই বিশ্বের সব থেকে দামী ফুটবলার তিনি। পেশাদার দুনিয়ায় সাফল্যই শেষ কথা।
সূত্র : আনন্দবাজার অনলাইন