মুদাসসির নিয়াজ
কৃষি, চাষবাস, খাদ্য, শস্য ইত্যাদি নিয়ে কবি, সাহিত্যিকরা অনেক কিছুই লিখেছেন। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে আন্দোলন, অনশন, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ এমনকি বিপ্লব পর্যন্ত হয়েছে। রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম-সংঘর্ষ ইতিহাসের পাতায় লিবিপদ্ধ রয়েছে। এ সবের সংমিশ্রণে কৃষিতে সবুজ বিপ্লবও ঘটেছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির বদান্যতায় জমির উর্বরতা বৃদ্ধির কৃত্রিম পথ পদ্ধতি সফলতা পেয়েছে। এক ফসলী জমি দুফসলী, বহু ফসলী হয়েছে। কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ইত্যাদি কত কী বের হয়েছে, যেগুলো কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে সহায়ক হয়েছে। আমাদের দেশ নদীমাতৃক হওয়ায় কৃষি প্রধান দেশের পংক্তিভুক্ত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “আমরা চাষ করি আনন্দে। মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে।” অন্যত্র লিখেছেন, “ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে পাকা ধান কাটে।”
আল্লাহকে শুকরিয়া জানিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল/মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানি’। আবার “কৃষকের ঈদ” কবিতায় ফুটে উঠেছে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত বেদনাময় আখ্যান, “একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার//উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি শিশু-পাঁজরের হাড়? ”
একইভাবে খাদ্যাভাব নিয়ে হাড় হাভাতে মানুষদেরকে লক্ষ্য করে সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন, “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।” এরকম বহু কবিতার ছত্রে ছত্রে উচ্চারিত হয়েছে কৃষি ও কৃষকের অস্মিতা।
আমরা বলে থাকি, পেট বড় বালাই। এখানে পেট মানে ক্ষুধা বা খিদে। এই পেটের জ্বালায় অনেক মানুষ নীচ ও হীন পথ অবলম্বন করতেও কুণ্ঠিত হয় না। বহু কবি-সাহিত্যিকের সৃজননীতে ক্ষুধাকে শিল্প বলেও কষাঘাত করা হয়েছে। অনেকেই তাঁদের বলিষ্ঠ উচ্চারণে নিরন্ন মানুষের ক্ষুৎ-পিপাসার মানচিত্র এঁকেছেন। দৈনন্দিন যাপনচিত্রে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে রূপসী বাংলা তথা ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরার ইতিকথা।
হাদিসে বলা হয়েছে, দুনিয়া হল আখেরাতের আবাদভূমি। এক অর্থে বলতে গেলে দুনিয়ায় আমরা যেমন আমল করব, আখেরাতে তেমনই ফল পাব। আবার অন্য অর্থে বলা যায় সমগ্র দুনিয়াই হল আমাদের জন্য কৃষিক্ষেত্র বা আবাদভূমি। এই দুনিয়ার মাটিতে কৃষিকাজ বা আবাদ করে আমরা আমাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পার্থিব সম্পদ ও উপাদান-উপকরণ আহরণ, প্রতিপালন এবং সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করতে পারি। এই সমগ্র প্রক্রিয়াকেই বলা হয় কৃষি। তাইতো বলা হয়, মানব জমিন রইলো পতিত, আবাদ করিলে ফলত সোনা।
ইসলাম তথাকথিত অর্থে কেবলমাত্র একটি ধর্ম নয়; বরং ইসলাম হল সমগ্র মানবজাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও সম্পর্কিত সমস্ত দিক ও বিভাগের জন্য ইসলামে গাইডলাইন বা রোডম্যাপ দেওয়া আছে। সুতরাং ইসলামের সিলেবাসে কৃষি বা চাষাবাদ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কৃষি সম্পর্কেও ইসলাম পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা দিয়েছে। পবিত্র কুরআন মজিদ ও হাদিসে এ ব্যাপারে মৌলিক নীতিমালা ঘোষিত হয়েছে এবং কৃষির উন্নয়নের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহই সর্বময় সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও রিজিকদাতা। তিনি কেবল এক নন, তিনি এককও। মানুষ সহ অন্যসব প্রাণীর আহার্যের উপকরণ তারই নিরঙ্কুশ সৃষ্টি। তবে মহান আল্লাহতায়ালা খাবার বা আহার্যের উপকরণগুলোকে অনুগ্রহ করে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের অধীন করে দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালার ঐশী কুদরত ও রহমতের দ্বারা আমরা মাটি থেকে ফসল ফলাই। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমি তো অঝোর ধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করেছি। অতঃপর মাটিকে বিদীর্ণ করেছি। আর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্যাদি, আঙুর, শাকসবজি, জলপাই, খেজুর, বহু বৃক্ষ বিশিষ্ট বাগান, ফলফলাদি ও ঘাস। এসব তোমাদের ও তোমাদের পালিত পশুকুলের জীবনধারণের জন্য।’ (সুরা আবাসা: ২৪-৩২)।
বলা হয়েছে- ‘বল তো কে সৃষ্টি করেছেন নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্য বর্ষণ করেছেন পানি, অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা-নহল : ৬০)।
উল্লেখ্য, ফসল বা খাদ্যশস্য উৎপাদন কেবলমাত্র মানুষের পরিশ্রমের কারণেই হয় না; বরং বীজ থেকে চারা, ভূগর্ভস্থ থেকে সেচ, শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ, সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া ইত্যাদি প্রতিটা কাজই হয় আল্লাহ তায়ালার অশেষ কুদরতি ব্যবস্থাপনায়।
বলা হয়েছে: তোমরা যে বীজ বপন কর সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা থেকে উৎপন্ন কর, না আমি উৎপন্নকারী? ইচ্ছা করলে, আমি তা খড়কুটো করে দিতে পারি। অতঃপর তোমরা হয়ে যাবে হতভম্ব।’ (সুরা ওয়াক্বিয়া : ৬৩-৬৫)।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, আমরা চাষাবাদ করলেও শাক, সবজি, ফল, ফসল কেবলমাত্র আমাদের প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হয় না। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আল্লাহর রহমত, বরকত ও নিয়ামত। না হলে বৃষ্টির পানিকে তিনি লবণাক্ত করে, অ্যাসিড বা ক্ষারীয় করে বর্ষণ করলে ফসল ফলতো না। মাটিকে অনুর্বর বা চাষযোগ্য না করে পাথুরে করে দিতে পারতেন। অথবা গোটা পৃথিবীর মাটিকেই তিনি বালুময় মরুভূমি করে দিতে পারতেন। তিনি ইচ্ছা করলেই বীজ থেকে অঙ্কুর উদগম্ হতো না। আল্লাহ নারাজ হলে এমন অনেক কিছুই নেতিবাচক হতে পারত। তখন বিশ্ব জুড়ে দুর্ভিক্ষ বা চরম খাদ্য সংকট দেখা দিত।
তাই আমাদের জীবন ধারণের জন্য আবশ্যিক সমস্ত রকম উপাদান ও উপকরণ একমাত্র আল্লাহই দেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ কারো প্রতি কৃপণ হোন না বা পক্ষপাত, বৈষম্য করেন না। তার আনুকূল্য থেকে কোনো মানুষ বঞ্চিত হয় না। সকলেই সমানভাবে উপকৃত হই।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি বৃক্ষরোপণ করে কিংবা খাদ্যশস্যের বীজ বপন করে, অতঃপর তা থেকে কোনো মানুষ, পাখি অথবা পশু কিছু অংশ খায়, তবে তার জন্য এই কাজ (বীজ বপন) সদকা হিসেবে বিবেচিত হবে।’
কৃষিকাজ করা কিংবা গাছ লাগানো জীবিকার একটি স্বাভাবিক মাধ্যম। যার উপকারিতা ও কল্যাণ মানুষ এবং পশুপাখি তথা সব জীবের ওপর সমানভাবে পৌঁছে থাকে। দ্বিতীয়ত, কৃষিক্ষেত্র থেকে মানুষ বা পশুপাখি যারই উপকার ও কল্যাণ হোক, তার বিনিময়ে অবশ্যই সে সাওয়াব পেতে থাকে। তাই কৃষির উন্নয়ন খুবই জরুরি।
মহানবী (সা.) বলেছেন, মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য প্রানীজ পুষ্টি বা আমিষের প্রয়োজন। যায় উৎস পশুপাখি বা প্রাণীকুল। তাই তোমরা ভেড়া ও গৃহপালিত পশুপালন কর। কারণ এরা সকাল-সন্ধ্যায় তোমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। তিনি আরও বলেন, দুনিয়ায় আল্লাহতায়ালার প্রেরিত সব নবীই মেষ চরিয়েছেন। নবীজি নিজেও মেষ পালন করেছেন। সুরা বাকারা ও সুরা আনয়াম- এই দুটি সুরার নামকরণ করা হয়েছে পশুর নামানুসারে। বাকারা শব্দের অর্থ গাভী এবং আনয়াম শব্দের অর্থ পশুসম্পদ।
সুস্বাদু ফল, ফসল, জ্বালানি ও আসবাব তৈরিতে গাছ তথা বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা, জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অন্যতম হাতিয়ার বৃক্ষরোপণ। তাই মহানবী (সা.) বৃক্ষরোপণের জন্য উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজেও বাগানে কাজ করেছেন। তিনি বৃক্ষরোপণ ও ফসল বপনকে সদকায়ে জারিয়াহ বলেছেন।
নবীজি বৃক্ষনিধন এমনকি অকারণে বৃক্ষের পাতা পর্যন্ত ছিঁড়তে নিষেধ করেছেন।
উপসংহারে যে কথা না বললেই নয়, সেটা হল ফসলের যাকাত। যাকে কুরআনে বলা হয়েছে উশর। আমরা জমিতে যে সব ফলমূল ও ফসল ফলাই, তার ১০ ভাগের এক ভাগ উসর আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ। সঠিক হিসাব করে যাকাত আদায় না করলে যেমন সেই টাকা হারাম বলে বিবেচিত হবে, ঠিক তেমনি উশোর যথাযথ আদায় না করলেও হারাম ভক্ষণ করা হবে। শুধু শুকরের মাংস কিংবা মদই হারাম নয়। যাকাত, উশর ঠিকঠাক আদায় না করলেও হারাম খাওয়া হবে। এগুলো আদায় করা মানে হলো আল্লাহর আদেশ, নির্দেশ মেনে চলা, আল্লাহর রহমত ও নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা এবং সর্বোপরি আল্লাহর নৈকট্য বা সান্নিধ্য লাভের পথ প্রশস্ত করে। মনে রাখতে হবে, যাকাত, উসোর ইত্যাদি হল গরীব মানুষের হক, যা আল্লাহ আমাদের কাছে আমানত হিসেবে রেখে আমাদের পরীক্ষা করছেন।
তাই আমরা যেন সব কাজে একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারি, আল্লাহ যেন আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করেন। আমীন