মুদাসসির নিয়াজ
বৃহস্পতিবার রায় দিয়েছিল সুরাত নিম্ন আদালত। সেই রায়ে কংগ্রেসের সেকেন্ড ইন কমান্ড রাহুল গান্ধীকে ২ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হল। সঙ্গে অবশ্য জামিনও দেওয়া হল। অর্থাৎ রাহুল গান্ধীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। একমাসের অব্যাহতিও দিল। এই সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা। আদালতের এত শিথিলতা থেকে বোঝা যায় এই মুহূর্তে রাহুল আইনের চোখে পুরোপুরি অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত নন।
কিন্তু সে সবের তোয়াক্কা না করেই রাহুলকে লঘু পাপে গুরুদণ্ড দিতে আদাপানি খেয়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়ল জাফরং শিবির। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা তড়িঘড়ি রাহুলের সংসদ পদ খারিজ করে দিলেন। অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থান বলে খ্যাত পার্লামেন্টে প্রবেশ নিষেধ হয়ে গেল একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির। শুধু তাই নয়, একইসঙ্গে রাহুল যে লোকসভা আসন থেকে জিতেছিলেন, কেরালার সেই ওয়ানাড কেন্দ্রকে সাংসদ-শূন্য বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিলো লোকসভা সেক্রেটারিয়েট। অর্থাৎ বল পুরোপুরি পাঠিয়ে দেওয়া হল নির্বাচন কমিশনের কোর্টে। এবার কেরালার ওই লোকসভা কেন্দ্রে যে কোনোদিন উপনির্বাচন ঘোষণা করতে পারে কমিশন। উল্লেখ্য, দোষী সাব্যস্ত হয়ে দু’বছরের বেশি কারাদণ্ডের সাজা হলেই আইনসভার সদস্যপদ চলে যায়।
আগামী ৬ বছর কোনও নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না রাহুল। অর্থাৎ আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনে যাতে রাহুল লড়তে না পারেন, সেই ব্যবস্থাই পাকাপাকি করতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। কংগ্রেসের অভিযোগ, পুরো বিষয়টা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ শতাব্দী প্রাচীন দল কংগ্রেস শুক্রবারই জরুরি বৈঠকে বসে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে। কংগ্রেস শাসিত সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রদেশ সভাপতিদের দিল্লিতে উপস্থিত হতে নির্দেশ দিয়েছেন কংগ্রেস হাইকমান্ড মল্লিকার্জুন খাড়গে।
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় কর্ণাটকে এক সভায় ললিত মোদি, নীরব মোদির প্রসঙ্গ তুলে নাম না করে কার্যত প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেছিলেন রাহুল। তাঁর ওই মন্তব্যকে আপত্তিকর বলে অভিযোগ করে সুরাতের নিম্ন আদালতে মানহানির মামলা দায়ের করেন গুজরাতের প্রাক্তন মন্ত্রী পূর্ণেশ মোদি। ৪ বছর পর পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের মাত্র এক বছর আগে সেই মামলার শুনানি শেষেই এদিন রাহুলকে দু বছর কারাদণ্ডের সাজা শোনায় সুরাত আদালত। রায় শুনে রাহুল বলেন, সত্য আমার ঈশ্বর। দেশের জন্য নির্ভিক চিত্তে লড়ে যাব। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
উল্লেখ্য, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, কর্ণাটক এর বিধানসভা ভোট আগামী মাসেই। ৪ রাজ্যেই অন্তর্ঘাত তীব্র। সুতরাং এর মধ্যে অন্তত ৩ রাজ্যে বিজেপির পরাজয় একরকম নিশ্চিত। তাই রাহুলের ঝোড়ো প্রচার যদি ৪ রাজ্যই কেড়ে নেয়, তাহলে ২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি একেবারেই কপর্দকশূন্য হয়ে যাবে। মূলত ভারত জোড়ো যাত্রা থেকেই রাহুলকে ভয় পাচ্ছিল মোদি-শাহ তথা গেরুয়া শিবির। তাই যে কোনো ছুতো-নাতায় কীভাবে রাহুলকে রাজনীতি থেকে আপাতত বানপ্রস্থে পাঠানো যায়, সেই ছক কষছিল তারা। তাই সুরাত নিম্ন আদালতের রায়ের পর বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করে।
কংগ্রেসের আইনজীবী সাংসদ অভিষেক মনু সিংভির দাবি, মানহানির মামলা করতে হয় নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে নীরব মোদি, ললিত মোদি। তাঁরা তো কেউ মামলা দায়ের করেননি। সুতরাং রাহুল উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হলে মানহানির মামলাটি খারিজ হয়ে যেতেও পারে। কারণ, মামলাটি নীরব মোদি বা ললিত মোদি করেননি, করেছিলেন গুজরাতের প্রাক্তন মন্ত্রী পূর্ণেশ মোদি।
উল্লেখ্য, রায় দিয়েছে নিম্ন আদালত। এর ওপর হাইকোর্ট এবং তার ওপর সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে। এক মাসের মধ্যে সুরাত আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রাহুল গান্ধী যে কোনও উচ্চ আদালতে আপীল করতে পারেন এবং করবেনও। যদিও শনিবার রাহুল সাংবাদিকদের বলেন, ৬ বছর কেন, সারা জীবনের জন্য সাংসদ পদ খারিজ করে দিলেও দেশ ও দশের জন্য তিনি লড়ে যাবেন এবং সর্বোপরি বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করেই ছাড়বেন।
কিন্তু যদি পাকিস্তানের ইমরান খানের মতো রাহুলকেও যদি রাজনীতি করাই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে কী হবে? উত্তরে বলা যায়, তাতে শাপে বর হবে। কংগ্রেস পার্টি শীঘ্রই কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরবে। তারপর রাহুলের ওপর থেকে নির্বাসন উঠে যাবে।
উল্লেখ্য, রাহুলের প্রেম, বিবাহ এমনকী জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও অনেক সময় বিভিন্ন বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা অনেক সময় কটাক্ষ করেছেন, অনেক কটূকথা বলেছেন। রাহুল বা কংগ্রেস কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করেননি। বরং রাজীব গান্ধীর হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিয়ে মহানুভবতার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন রাজীবের বিধবা স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং তাঁর দুই সন্তান রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা। কিন্তু মোদির নামে কেউ কিছু বললে তাকে দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দিয়ে কালাকানুনে জেলে ভরে দেওয়া হচ্ছে। মোদি হটাও দেশ বাঁচাও স্লোগান দিয়ে দিল্লিতে পোস্টার পড়লে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। ইদানীং এ রকমই অদ্ভূত সব কাণ্ড কারখানা দেখা যাচ্ছে। এভাবেই হিটলার ও গোয়েবলসীয় কায়দায় গণতন্ত্র, বাদ স্বাধীনতাকে গলাটিপে হত্যা করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে আমরা ক্রমেই অমানিশার অন্ধকারে চলে যাচ্ছি। ২০২৪ সালে কি বিকল্প দেখা যাবে? যারা ১৩০ কোটির দেশের সামনে আলোকবর্তিকা হবে?
এখন প্রশ্ন হল, প্রধান বিরোধী দলের অন্যতম শীর্ষনেতার বিরুদ্ধে শাসক দল যেভাবে কোমর বেঁধে নেমেছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে রাহুলকে এখন রীতিমতো ভয় পাচ্ছে বিজেপি। কারণ, ১৯ বছর আগে পার্লামেন্টে পা রাখা রাহুল এখন যথেষ্ট পরিণত ও পরিশীলিত। কিন্তু রাহুলের মতো উচ্চতর নেতার ২ বছর কারাদণ্ডের পাশাপাশি সাংসদ পদ খারিজ এবং ৬ বছর রাজনীতিতে প্রবেশ নিষেধ করার মাধ্যমে ফের স্পষ্ট হল যে, দেশের গণতন্ত্র গভীর সংকটে নিমজ্জিত। এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, কংগ্রেস-মুক্ত ভারত গড়তে তারা সবকিছু করতে রাজি। বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রকে উৎখাত করে একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতির মৌরসীপাট্টা কায়েম করতে তারা কাউকে রেয়াত করবে না, কারও পরোয়া করবে না।
শনিবার সাংবাদিক সম্মেলনে রাহুল আরও বলেন, গৌতম আদানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক কী! কীভাবে আদানির ঝুলিতে ২০ হাজার কোটি টাকা এল, এসব নিয়ে প্রশ্ন করাতেই আমার বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ। আসলে মানুষকে বিপথে চালিত করতেই এই আয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর চোখে আমি আদানি নিয়ে প্রশ্নের ভয় দেখেছি। রাহুলের আরও অভিযোগ, তাঁর বিরুদ্ধে লাগাতার মিথ্যাচার করেছে বিজেপি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলেছেন। বিজেপির উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে তিনি বলেছেন, আমি গণতন্ত্রকে বাঁচানোর লড়াইতে নেমেছি। আমি সত্য ছাড়া আর কিছুতেই আগ্রহী নই। সংসদে থাকি আর না থাকি, আমি লড়াই থামাব না। এটা আমার রক্তে আছে।
রাহুল গান্ধীকে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিয়ে দশ চক্রে ভগবানের মতো ভূত বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে কিন্তু হীতে বিপরীত হতে চলেছে। এতদিন বিরোধীদের মধ্যে সেরকম কোনও সমন্বয় দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু শুক্রবার রাহুল গান্ধীর লোকসভার সদস্যপদ খারিজ হতে না হতেই সেই ছবি উধাও। প্রায় সব বিরোধী দল একসুরে চরম আক্রমণ করেছে বিজেপি তথা মোদি সরকারকে। সকলের এক অভিযোগ—গণতন্ত্র বিপন্ন! ফলে অস্বস্তি বাড়ছে বিজেপির অন্দরে।
রাহুল ইস্যু বিরোধীদের হঠাৎ এক ছাতার নীচে নিয়ে এসে সম্মিলিত এক শক্তিতে পরিণত করবে না তো? প্রথম দিন থেকে এই ভয় গ্রাস করেছে গেরুয়া শিবিরকে। কারণ, গত শতাব্দীর সাতের দশকে রাহুলের ঠাকুমা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জেলে যেতে হয়েছিল। তার জেরে দেশবাসীর সহানুভূতি পেয়ে যান তিনি। আর তিন বছরের মধ্যেই পরবর্তী নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে ফিরে আসেন। এদিনের ঘটনায় সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির গন্ধ পাচ্ছে রাজনৈতিক মহল।
এই ঘটনায় রাজনৈতিকভাবে বিজেপির লাভ কতটা হবে? ক্ষতিও বা কী হতে পারে? এই নিয়ে বিজেপির অন্দরে জোরদার জল্পনা শুরু হয়েছে। গোটা বিষয়টিকে ঢাল করে এবার আরও আক্রমণাত্মক হওয়ারই প্ল্যান গেরুয়া শিবিরের। দেশজুড়ে রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে শুরু করা হবে প্রচার—মোদি পদবিকে অপমান করে আসলে অনগ্রসর শ্রেণিকে অসম্মান করেছেন তিনি।
অন্যদিকে, মুখে প্রকাশ করতে না পারলেও বিজেপির অন্দরে কিন্তু জন্ম নিয়েছে ভিন্ন ভাবনা। এর ফলে রাহুল গান্ধী নায়ক হয়ে গেলেন না তো? আগামী দিনে দেশজুড়ে তিনি ও কংগ্রেস নেতারা তো প্রচার করতে পারেন যে, তাঁকে সংসদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস এই ইস্যুকে কোনদিকে এবং কীভাবে নিয়ে যাবে, তা নিয়েও ধোঁয়াশায় বিজেপি। তবে রাহুল গান্ধী যদি সহানুভূতি পেতে শুরু করেন এবং সেটাকে আগামী ভারত জোড়ো যাত্রায় পুঁজি করেন, তাহলে প্রতিরোধ করা যাবে কীভাবে? এই নিয়েও রীতিমতো জল্পনা চলছে বিজেপির মধ্যে। তবে তাদের সবথেকে বড় শঙ্কা এখন, বিরোধীদের মধ্যে এই ইস্যুতে ঐক্যের সুর। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে, এত তাড়াহুড়ো করা হল কেন? উচ্চ আদালতের রায়ের অপেক্ষা করা হল না কেন? এভাবে তো বিশ্বের দরবারে ভারতীয় গণতন্ত্রকে কালিমালিপ্ত করা হল।