প্যারিসে ১৭ বছরের তরুণ নাহেলের মৃত্যুর জেরে গত পাঁচদিন ধরেই বিক্ষোভ সহিংসতায় উত্তাল ফ্রান্স।
শনিবার (১ জুলাই) রাতে সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত ছিল ফ্রান্সের মার্সেই শহর। সেখানে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে বিক্ষোভকারীদের দমন করতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করছে।
কর্মকর্তারা বলেন, ফ্রান্সে দক্ষিণাঞ্চলীয় এই শহরে শনিবার রাতেই কমপক্ষে ৫৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তবে প্যারিসের পরিস্থিতি তুলনামূলক শান্ত ছিল ওই দিন রাতে। সেখানে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে বিক্ষোভকারীরা সংগঠিত হতে পারেনি।
অব্যাহত বিক্ষোভ-সহিংসতার মধ্যেই শনিবার নাহেলের দাফন সম্পন্ন হয়। নানতেরে শত শত মানুষ তার জানাজায় অংশ নিয়েছিল।
আলজেরীয় বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী তরুণ নাহেল মেরজুকের মৃত্যুর পর গত মঙ্গলবার (২৭ জুন) থেকেই ফ্রান্সজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, শনিবার রাতেই কমপক্ষে ৪২৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর পাশাপাশি তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন এই বলে যে ‘তাদের পদক্ষেপের জন্যই শনিবার রাতের পরিস্থিতি শান্ত ছিল।’ অব্যাহত দাঙ্গা ঠেকাতে শনিবারেই ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে প্রায় ৪৫ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শনিবার জানিয়েছিল, চার দিনে কমপক্ষে দুই হাজার তিন শ’ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার মধ্যে শুক্রবার রাতেই গ্রেফতার করা হয় এক হাজার তিন শ’ ১১ জনকে।
ফ্রান্সের বিচারমন্ত্রী বলেন, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৩০ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছরের কম।
শনিবার বিকেল থেকেই মার্সেই শহরের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে মার্সেইয়ের কেন্দ্রস্থল লা ক্যানেবিয়েরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
ফরাসি মিডিয়াগুলোর খবর অনুযায়ী ওই এলাকায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে লড়াই চলে।
তবে প্যারিসে পুলিশি টহল ছিল অনেক। রাজধানীর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, কিছু বিক্ষোভকারী সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হবার চেষ্টা চালায়, কিন্তু তারা আর সংগঠিত হতে পারেনি। স্থানীয় সময় রাত নয়টার পর থেকে গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়। সহিংসতার আশঙ্কায় শনিবার রাতে কমপক্ষে ২৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
যেভাবে সহিংসতার শুরু
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের নানতেরে এলাকায় নাহেল এম নামের ওই তরুণ মঙ্গলবার গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় ট্রাফিক পুলিশ তাকে থামতে বলে। সে না থামলে পুলিশ খুব কাছে থেকে তাকে গুলি করে।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, একজন পুলিশ অফিসার একটি গাড়ির চালকের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। এরপর একটি গুলির শব্দ শোনা যায় এবং তারপর গাড়িটি থেমে যায়।
বুকে গুলিবিদ্ধ নাহেলকে জরুরি চিকিৎসা দেয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। গুলিবর্ষণকারী অফিসারটিকে হত্যার অভিযোগে আটকও করা হয়।
ফরাসী মিডিয়ায় বলা হয়, পুলিশ প্রথমে ইঙ্গিত দিয়েছিল যে তরুণটি তাদের দিকেই গাড়িটি চালিয়ে দিয়ে পুলিশদের আহত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে ধারণা হয় যে প্রকৃত ঘটনা ছিল ভিন্ন।
এ ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাত থেকেই প্যারিস ও অন্য আরো কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ ও সহিংসতা শুরু হয়।
গাড়ি ও বাসস্টপে আগুন দেয়া হয়, কিছু রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হয়, আক্রান্ত হয় পুলিশ স্টেশনও। রায়ট পুলিশ বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দিতে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে।
যে পুলিশ অফিসারের গুলিতে নাহেল মারা যান, তিনি তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে ‘ইচ্ছেকৃতভাবে খুনের’ অভিযোগ আনা হয়েছে।
নাহেলের মৃত্যু ফ্রান্সে বর্ণবাদ এবং সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাপারে ক্ষোভ উস্কে দিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পুরো ফ্রান্স সহিংস বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে।
কে এই নাহেল এম?
প্যারিসের নানতেরে শহরেই বেড়ে ওঠেন ১৭ বছর বয়সী নাহেল এম। তিনি খাবার ডেলিভারির কাজ করতেন এবং রাগবি লিগে খেলতেন।
একমাত্র সন্তান নাহেলকে বড় করেছেন তার মা।
নাহেলের পড়ালেখা কিছুটা অগোছালো হিসেবে বর্নণা করা যায়। ইলেকট্রিশিয়ান হতে চেয়েছিল নাহেল। আর সেজন্যে যে এলাকায় তার বসবাস ছিল, তার কাছেই সুরেসনেসের একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিল তিনি।
যারা নাহেলকে চেনেন, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী নাহেল ভালো ছেলে ছিল এবং সবাই তাকে ভালোবাসতো।
নাহেল ও তার মা মোনিয়া আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত, তবে তার বাবা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি।
কলেজে নাহেলের ক্লাসে ছিল উপস্থিতি কম। তিনি হয়তো এর আগেও কোনো সমস্যায় জড়িয়ে পড়ার কারণে পুলিশের কাছেও তিনি পরিচিত ছিল।
তবে নাহেলের পরিবারের আইনজীবী জোর দিয়ে বলছে, তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই।
নাহেলের মৃত্যুর পর তার মা মুনিয়া সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেন, ‘তিনি (নাহেল) সকাল বেলাও বলছিল মা আমি তোমাকে ভালোবাসি, তারপর কাজে যায়। এর এক ঘণ্টা পর আমি একটা ফোন পাই-আমাকে বলা হয় আমার ছেলেকে গুলি করা হয়েছে।’
‘আমি এখন কী করব?’ প্রশ্ন করে নাহেলের মা বলেন, ‘আমি আমার সবকিছু তার জন্য উৎসর্গ করেছি। আমার দশটি নয়, মাত্র একটিই সন্তান। তিনি (নাহেল) আমার জীবন ছিল, আমার কাছের বন্ধু ছিল।’
নাহেলের নানী নাহেলকে বর্নণা করেছেন ‘নরম মনের ভালো একটা ছেলে’ হিসেবে।
সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা অলিভিয়ের ফাউর বলেন, ‘নির্দেশমতো গাড়ি না থামানো মানে এই নয় যে কাউকে হত্যার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন ‘রাষ্ট্রের প্রতিটি শিশুর ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।’
নাহেল গত তিন বছর পাইরেটস অব নানতেরে রাগবি ক্লাবে খেলেছে।
স্কুলে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে এমন কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটি কর্মসূচি পরিচালনা করে ‘ওভাল সিটিয়েন’ নামের একটি সমিতি। ওই কর্মসূচিতেও অংশ নিতেন নাহেল।
ওভাল সিটিয়েনের এই কর্মসূচির লক্ষ্য হলো সুবিধাবঞ্চিত এলাকার মানুষকে শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়া। নাহেল সেখানে ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ শিখছিলেন।
ওভালে সিটিয়েনের প্রেসিডেন্ট জেফ পুয়েচ তাকে খুব ভালো করে চিনতেন। কয়েক দিন আগেই তার সাথে জেফের দেখা হয়েছিল।
‘সব বাধা কাটিয়ে রাগবি নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি’ বলছিলেন জেফ।
‘তিনি এমন একটি ছেলে ছিল, যার মধ্যে সামাজিকভাবে ও পেশাগতভাবে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে ওঠার আগ্রহ ছিল। যারা মাদক বা কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তাদের মতো ছিলেন না তিনি।’
নাহেলের ‘আচরণ উদাহরণ হিসেবে নেয়ার মতো’ বলে প্রশংসাও করেন জেফ।
নাহেলের মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরই অ্যাম্বুলেন্সের এক চালক মারোয়ান এক পুলিশ কর্মকর্তাকে তিরস্কার করেন। পরে এই বিষয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, নাহেলকে তিনি চিনতেন এবং তিনি ছিল তার ছোট ভাইয়ের মতো। তিনি তাকে বেড়ে উঠতে দেখেছেন।
ওই অ্যাম্বুলেস চালক সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি খুব নরম মনের ছেলে ছিল, সবাইকে সাহায্য করত। তিনি কখনো কারো ওপর হাত তোলেননি এবং সহিংস মনোভাবেরও ছিলেন না।’
নাহেলের মা মোনিয়া মনে করেন ‘ওই পুলিশ কর্মকর্তা নাহেলের চেহারা আরব দেশের নাগরিকের মতো দেখতে পেয়ে তার জীবন নিতে চেয়েছে।’
তিনি ফ্রান্স পাঁচ টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শুধুমাত্র ওই পুলিশকে দোষারোপ করেছেন, পুরো পুলিশ বাহিনীকে কিছু বলেননি।
তিনি বলেন, ‘আমার অনেক বন্ধু পুলিশে আছে, তারা আমার পাশে আছে।’
‘পুলিশের সহিংসতা এখানকার প্রতি দিনের ঘটনা। বিশেষ করে আপনি যদি আরব বা কৃষ্ণাঙ্গ হো’-বলছিলেন ফ্রান্সের এক শহরের তরুণ, যিনি নাহেল হত্যার বিচার চেয়ে রাস্তায় বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন।
তবে নাহেলের পরিবারের আইনজীবী ইয়াসিন বুজরু বলেন, ‘এটা শুধু বর্ণবাদের বিষয় নয়, এখানে ন্যায়বিচারের বিষয়ও রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থা এমন যেটা পুলিশ কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দেয়। যে আইনের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।’
সূত্র : বিবিসি