নুহতে হিংসা: সাম্প্রদায়িক জিঘাংসা ছড়াতে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠিগুলির ঘৃণা, হুমকি ও গুলি বর্ষণ

আগষ্টের ৩ তারিখ সিপিআইএমএল ও এআইসিসিটিইউ-র দুটি তথ‍্যানুসন্ধানী দল হরিয়ানার নুহ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল পরিদর্শন করে, যে জায়গাগুলোতে ৩১ জুলাই ২০২৩ তীব্র সাম্প্রদায়িক উসকানি ও হিংসার ঘটনা ঘটিয়েছে দক্ষিনপন্থী গ্রুপগুলো। তথ‍্যানুসন্ধানী দল দুটির একটিতে (টিম-১) ছিলেন সিপিআইএমএল কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর সদস‍্য কমরেডস প্রেম সিং গহলোয়াত, রবি রাই, স্বেতা রাজ, আকাশ ভট্টাচার্য ও অরুণ। তাঁরা নুহ (মেওয়াট) ও সোহনা (গুরগাঁও)-এর মুসলমান ও হিন্দু- উভয় ধর্মের মানুষের সাথে দেখা করেন এবং এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হল ভূমিস্তরের সেই ঘটনা পরম্পরা বোঝার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় দলটিতে (টিম-২) ছিলেন এআইসিসিটিইউ সদস‍্য কমরেডস অভিষেক, অমরনাথ শর্মা ও এডভোকেট গণেশ (একজন মানবাধিকার বিষয়ক উকিল)। তাঁরা সেক্টর 70-A’র নিকটবর্তী পারলা গ্রামের মুসলমান শ্রমিক বস্তিগুলি, ভোণ্ডসি গ্রাম এবং সোহনা গ্রাম পরিদর্শন করেন।

টিম দুটি তাঁদের তদন্তে দেখতে পায় যে, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরিতে ‘শোভাযাত্রা’-কে ঘিরে সম্প্রতি যে ধরণের সাম্প্রদায়িক হিংসা তৈরি করা হয়েছিল সেই একই প‍্যাটার্নে নুহ্তেও বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মত দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠিগুলি ‘শোভাযাত্রা’ নিয়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ায়। বজরং দল ও ভিএইচপির সংগঠিত এইসব বিরাটাকার ‘শোভা যাত্রাগুলি’ সাম্প্রতিক পরিঘটনা। নুহ্তে যেমন মাত্র তিন বছর আগে থেকে এটা শুরু হয়েছে। তার আগে এইসব জুলুসের প্রায় সবগুলিই স্থানীয় স্তরে সংগঠিত হত এবং সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হত।

দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠিগুলির দ্বারা ৩১ জুলাই শোভাযাত্রার আগে চালানো তীব্র মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষ ও ভীতি প্রদর্শন অভিযানের দিকে আঙুল তোলেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় পরিচিতি নির্বিশেষে। দক্ষিণপন্থী ঠ‍্যাঙাড়ে বাহিনীর মনু মানেসর, যিনি ২০২৩’র ফেব্রুয়ারি মাসে নাসির ও জুনেইদের নৃশংস হত‍্যাকাণ্ডের মূল আসামী, এবং বজরং দলের নেতা বিট্টু বজরঙ্গী, যিনি ৩১ জুলাইয়ের মিছিলে উপস্থিত ছিলেন -এই দুজনের চরম উসকানিমূলক ভিডিও পোস্টের পরেও পুলিশ কোনও নিবারণমূলক পদক্ষেপ নেয় নি। নুহ্তে হিংসা ছড়িয়ে পড়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে ভিএইচপির সাধারণ সম্পাদক সুরেন্দ্র জৈনকে দেখা গেছে মেওয়াটে মেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ-ভাষণ দিতে। নুহর একটি মন্দিরের সামনে উপস্থিত এক বিশাল জমায়েতকে সম্বোধিত করে তিনি আহ্বান রাখেন, মুসলিম জনাধিক‍্যের মেওয়াত এলাকাটির চরিত্র বদলে দেওয়ার।

স্থানীয়দের মতে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা তলোয়ার, পিস্তল ও আধুনিক সফিস্টিকেটেড বন্দুকে সসজ্জিতভাবে সশস্ত্র ছিল। যখন তারা নুহ শহরের মধ‍্যে দিয়ে যাচ্ছিল তখন অস্ত্র উঁচিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক শ্লোগান দিচ্ছিল এবং স্থানীয়দের বিভিন্নভাবে হয়রান করছিল। এই উসকানির ফলে এবং মনু মানেসর প্রচারিত ভিডিওর ঘৃণা ভাষণে ইতিমধ‍্যেই স্থানীয় জনতার মনে জমে থাকা ক্রোধের কারণে, তীব্র সংঘাত শুরু হয়।

ঘটনা পরম্পরা থেকে এটা দেখা গেল যে নুহর প্রাথমিক হিংসার পর সামাজিক গণমাধ‍্যমকে ব‍্যবহার করে হিন্দু-বিরোধী প্রবল আক্রমণের বানোয়াট গল্প ও অনেক হিন্দুর খুন হয়ে যাওয়ার মিথ‍্যা কাহিনী ব‍্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। হিংসা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে গুরগাঁওয়ের সোহনা ও অন‍্যান‍্য স্থানে, যেখানে কয়েকশ পুরুষ মানুষের দক্ষিণপন্থী জটলা মুসলমানদের দোকানগুলিতে এবং মসজিদে হামলা চালায়। রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং মুসলমানদের, শিশুদের সহ, বিশেষভাবে নিশানা বানানো হয়েছিল। এই সম্প্রদায়ের স্থানীয় মানুষদের মতে, এত হিংস্র আক্রমণ সত্বেও পুলিশ সম্পূর্ণ নিরব ছিল।

*স্থানীয়রা পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়ায়*

দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠিগুলি সাম্প্রদায়িক সংঘাতককে ব‍্যাপ্ত দাঙ্গার রূপ দেওয়ার অনেক চেষ্টা চালানো সত্বেও ধর্ম নির্বিশেষে স্থানীয় সাধারণ মানুষের মধ‍্যে বিরাজমান সংহতি বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে দেয় এবং এই বিস্ফোরক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনে। সোহনা মসজিদে হামলার নির্দিষ্ট ঘটনাটিতে দক্ষিণপন্থী গুণ্ডাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ রুখে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের সুরক্ষা দেন। মেওয়াত এলাকার জাঠেরাও হিংসার বিরুদ্ধে স্থানীয় মুসলমানদের পাশে এসে দাঁড়ায়।

নুহ্তে, ঐ সম্প্রদায়ের অনেকেই বলেন যে, দাঙ্গাবাজরা ওই এলাকার বাইরে থেকে এসেছিল। নুহ্ ও সোহনা দুই জায়গার স্থানীয়রাই পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। নুহর শান্তি কমিটি আগেই স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছিল মনু মানেসরকে এনে এলাকায় সাম্প্রদায়িক জিঘাংসা তৈরীর অপচেষ্টার কথা। কিন্তু শোভাযাত্রার সময় পুলিশ প্রহরা ছিল নামমাত্র।

*রাষ্ট্র অপরাধীদের দোসর হয়ে যায়*

হরিয়ানা ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিষিয়ে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ জানান স্থানীয় মানুষেরা। তাঁরা বলেন যে নুহর হিংসা রাষ্ট্রের যোগসাজসের ফলেই ঘটেছে, এই অস্থির পরিস্থিতি সম্পর্কে ওরা আগে থেকেই জানত, তবু তা নিবারণে কোনো পদক্ষেপ নেয় নি। প্রকৃতই, ঘৃণাভাষণ ও মিছিলে সশস্ত্র সমাবেশ সম্পর্কে আগাম খবর থাকা সত্বেও তার বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কোনওরকম ব‍্যবস্থা নেওয়া হয় নি।

স্থানীয়রা সচেতন ভাবে ব‍্যক্ত করেছেন যে নুহর পরিস্থিতিকে রাজ‍্য জুড়ে এবং সারা দেশ জুড়ে চলমান সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সাথে সংযুক্তরূপেই বুঝতে হবে। বছরের পর বছর ধরে দক্ষিণপন্থী গ্রুপগুলো বিজেপি সরকারের অপরাধসুলভ সহযোগিতায় মেওয়াত অঞ্চলে হিংস্র হিন্দুত্ব প্রকল্প নামিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

*গরিব পরিযায়ি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে এক অভিযান*

নুহ্ ও গুরগাঁওয়ের এলাকাগুলিতে দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠিগুলি ও স্থানীয় প্রশাসন মুসলমান পরিযায়ি শ্রমিক জনসংখ‍্যাকে, বিশেষত যারা বাংলা থেকে ওখানে গেছেন তাঁদে, নিশানা করে সুসমন্বিত অভিযান চালিয়েছে। বেশ কিছু মুসলমান বস্তি এলাকা, বিশেষ করে গুরগাঁওয়ের, আক্রান্ত হয় অথবা বসতি ফাঁকা না করলে হামলা চালানো হবে বলে হুমকির সম্মুখীন হয়। গরিব মুসলমানদের মধ‍্যে ত্রাস তৈরি করতে সামাজিক গণমাধ‍্যম ও মূলধারার মিডিয়া- উভয় মাধ‍্যমেই খবর করা হয়েছে ‘রোহিঙ্গ‍্যা মুসলমান’ তকমা জুড়ে দিয়ে।

যখন তথ‍্যানুসন্ধানী দলের সদস‍্যরা কয়েকজন পরিযায়ি শ্রমিকের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন তখন পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। বেশিরভাগ বস্তিগুলিই এখন ফাঁকা, অনেকেই শহর ছেড়ে পালিয়েছেন।

প্রতিহিংসা ও সন্ত্রাসের ভয়

নুহ্তে এবং গুরগাঁওয়ের বেশ কিছু অঞ্চলে পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগপূর্ণ। গুরগাঁওয়ের যে অঞ্জুমান জামা মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় এবং তার ইমামকে হত‍্যা করা হয়, সেই মসজিদ পরিদর্শনের সময় তথ‍্যানুসন্ধানী দল দক্ষিণপন্থী বাহিনীর যুবকদের বাইকে চক্কর মারতে ও আরো ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা চালাতে দেখে। পরবর্তীতে অবশ‍্য এই গ্রুপকে পুলিশ তাড়া করে সরিয়ে দেয়।

টিম যখন নুহ পরিদর্শন করছিল তখন শহরটাকে এক ভুতুড়ে শহর মনে হচ্ছিল: সমস্ত দোকানপাট বন্ধ, বাড়ির বাইরে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কার্ফিউ চলছে। স্থানীয়রা বলেন যে, পুলিশ গণহারে গ্রেপ্তার ও রেইড চালাচ্ছে, অনেক নিরীহ ব‍্যক্তিকেও তুলে নিয়ে গেছে। মেও মুসলমান জনতার মধ‍্যে ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে। সিপিআইএমএল প্রতিনিধি দল নুহর ডেপুটি কমিশনারের সাথেও দেখা করেন এবং বহুসংখ‍্যক নিরপরাধ ব‍্যক্তিকে গ্রেপ্তার, যা স্থানীয় জনতার মধ‍্যে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করেছে, সে সম্পর্কে উদ্বেগ ব‍্যক্ত করেন। দলটি তাদের বিবৃতিতে এইসব তথ্য জানায়।

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও