নীতিশ কুমারের বিশ্বাসঘাতকতা সত্বেও বিহার মোদি শাসনের বিপর্যয় থেকে দেশকে বাঁচাতে বুনিয়াদি ভূমিকা নেবে

 

নীতিশ কুমার আরো একবার শিবির পাল্টালেন। যে বিজেপি ঔদ্ধত‍্যের সাথে বলেছিল যে নীতিশের জন‍্য তাদের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল তারাই এখন নীতিশকে এনডিএ’র মুখ‍্যমন্ত্রী রূপে পুণরায় বরণ করে নিল। আর নীতিশ কুমার, যিনি বিজেপির সাথে আবার হাত মেলানোর থেকে মৃত‍্যু বরণ করাও শ্রেয় বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে আবার বিজেপির কোলে ঢলে পড়লেন। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি বিহারে ক্ষমতা দখল করতে মরিয়া ছিল এবং নিতিশ কুমার বজেপির সেই খেলায় নিজেকে বোড়ে হিসেবে সমর্পণ করলেন। বিজেপি ভাবছে নীতিশকে বিরোধী শিবির থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইণ্ডিয়া জোটের টেবিল উল্টে দিতে পারবে। কিন্তু বাকি কথা বাদ দিলেও একথা খুব পরিস্কার যে এর মাধ‍্যমে বিজেপির দুর্বলতা তথা বিহারের সম্মিলিত বিরোধী শক্তিকে বিজেপির ভয় পাওয়াকে স্পষ্ট দেখিয়ে দিল। ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধীপক্ষের সম্মুখীন হয়ে বিজেপির আসন যে ৫৩টিতে নেমে এসেছিল সেই স্মৃতি এখনও নিশ্চয় ওদের তাড়িয়ে ফিরছে।

বাতাসে নানা ফিসফাস ভেসে বেরাচ্ছে কেন নীতিশ আবার পাল্টি খেলেন। প্রয়োজনবাদী রাজনীতির অঙ্গনে সর্বদাই টিকে যাওয়া রাজনীতিবিদদের মধ‍্যে সেরা হিসেবে নীতিশ কুমার সর্বজনবিদিত, এমনকি রামবিলাশ পাশোয়ানের থেকেও বেশি যিনি গুজরাট গণহত‍্যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০২ সালে এনডিএ শিবির ত‍্যাগ করে এক দশক কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটে থেকেও আবার বিজেপির কাছে ফিরেছিলেন। ২০১৩ সাল নাগাদ বিজেপি নরেন্দ্র মোদিকে তাদের প্রধান জাতীয় নেতা হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করার আগে পর্যন্ত নীতিশ কুমার বিজেপির দীর্ঘস্থায়ি সহযোগী ছিলেন। ২০১৫ সালে আরজেডি ও কংগ্রেসের সাথে মিলে বিধানসভা নির্বাচন জিতে তেজস্বী যাদবকে উপমুখ‍্যমন্ত্রী রেখে সরকার চালানোর পর ২০১৭ সালে আবার তিনি এনডিএতে ফিরে যান। ২০২২ এর আগষ্ট মাসে নীতিশ কুমার আরো একবার বিজেপির সঙ্গ ছাড়েন ১৭ মাস পর বর্তমানে আবার এনডিএ শিবিরে যোগ দেওয়ার আগে।

রাম বিলাস পাশোয়ানকে সকলে মজা করে “আবহাওয়া বিজ্ঞানী” বলে চিহ্নিত করে থাকে এবং নীতিশ কুমার এখন “পাল্টুরাম” নামেই অধিক পরিচিত হয়ে উঠেছেন, অথবা “কুর্শি কুমার”। কিন্তু মহাগঠবন্ধন সরকারের মুখ‍্যমন্ত্রী হিসেবে সত‍্যিই কি তিনি বিপন্ন বোধ করছিলেন যে তাঁকে কুর্শি সুরক্ষিত রাখতে আবার পাল্টি খেতে হল? বাস্তব তথ‍্য উল্টো কথাই বলছে। বিজেপির ক্রমবর্ধমান চাপ প্রতিরোধ করতেই মূলত এনডিএ ছেড়েছিলেন তিনি এবং এখন আবার এনডিএতে ফেরায় আর যাই হোক সেই চাপ বাড়বে বৈ কমবে না। ইণ্ডিয়া জোটের কনভেনর তিনি হতে পারলেন কি না তার সাথে জোট ত‍্যাগের সম্পর্ক খোঁজাও অর্থহীন। ইণ্ডিয়া জোটের ঐক‍্য মজবুত করা ও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত করার উদ্দেশ‍্যে জোট শরিকদের সমালোচনা করা এক জিনিস, জোট ছেড়ে শত্রুদলে যোগ দেওয়া সম্পূর্ণ আলাদা ব‍্যাপার।

আপনধারার এক সোশালিস্ট নেতা যিনি এমনকি গুজরাট গণহত‍্যার পরও বিজেপির ঘনিষ্ঠ সঙ্গি হয়ে থেকেছেন এবং যিনি মোদি জমানাতেই পরপর দুটি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি শিবিরে দুবার যোগ দিয়েছেন তাঁর মূল রাজনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে আমাদের কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। বিশ্বাসযোগ‍্যতা না থাকার ট্র‍্যাক রেকর্ড সত্বেও বিহারের মহাগঠবন্ধন এবং জাতীয় স্তরের ইণ্ডিয়া জোট নীতিশ কুমারকে বিহারের মুখ‍্যমন্ত্রী হিসেবে এবং সর্বভারতীয় স্তরে জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক হিসেবে যথাযথ মর্যাদার সাথেই গ্রহণ করেছিল। তথাপি নীতিশ কুমার ইণ্ডিয়া জোটের সাথে প্রতারণার রাস্তাই বেছে নিলেন ২০২৪এর অতীব গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের প্রাক্কালে, যখন কিনা সারা দেশ গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা, সামাজিক ন‍্যায় ও সাম্প্রদায়িক সংহতি রক্ষায় রাজনৈতিক শক্তিগুলির মধ‍্যে ব‍্যাপক বিস্তৃত ঐক‍্যের লক্ষ‍্যে বিহারের দিকে তাকিয়ে আছে।

নীতিশ কুমারের জোটত‍্যাগকে তাই গণতন্ত্র ও সামাজিক ন‍্যায়ের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই কেবল দেখা চলে। এই বিশ্বাসঘাতকতাকে আরো নির্লজ্জ প্রতিপন্ন করে তুলেছে পাল্টি খাওয়ার জন‍্য বেছে নেওয়া সময়টা –কর্পুরি ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের ৭৪তম বার্ষিকী। নীতিশ কুমার আপনা স্টাইলে নিজেকে পরিবেশন করে থাকেন কর্পুরি ঠাকুরের উত্তরাধিকারি হিসেবে। কিন্তু দুজনের সঞ্চারপথ দেখলে দেখা যাবে তারা সম্পূর্ণ পরস্পর বিরুদ্ধ। তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে কর্পুরি ঠাকুরকে বিহারের ভয়ানক সামন্তি-সাম্প্রদায়িক শিবির, বিশেষত আরএসএস ও জনসঙ্ঘকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল ওবিসিদের, যার মধ‍্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের ব‍্যাকওয়ার্ড কাস্টও অন্তর্ভুক্ত, সংরক্ষণ লাগু করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার জন‍্য। বিহারের মুখ‍্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দুবারের পর্বই ছিল অত‍্যন্ত স্বল্পস্থায়ি এবং তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগটাই কাটিয়েছেন বিরোধী দলনেতা হিসেবে। এবং ইমার্জেন্সি পরবর্তী বিহারে, বিশেষত সিপিআইএমএল’র নেতৃত্বে গ্রামীণ গরিবদের বৈপ্লবিক আন্দোলনের উত্থানের পর, তিনি কমিউনিস্ট-সোশালিস্ট ঐক‍্যের জোরালো প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন।

বিজেপির গেমপ্ল‍্যান সম্পর্কে বলতে গেলে, এটা সকলেরই জানা যে এই দলটা সমস্ত বড় রাজ‍্যেই প্রত‍্যক্ষ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে মরিয়া। অ-বিজেপি সরকারগুলি মোদি সরকারের গলার কাঁটা। মহারাষ্ট্রের মহা বিকাশ আঘাড়ি সরকারকে ভেঙে দেওয়া ও দিল্লি সরকারের সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পর স্পষ্টতই ওদের নজর পড়েছে দেশের পূর্বভাগের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খণ্ড রাজ‍্যে। পাটনায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর এক মুহুর্ত বিলম্ব না করেই মোদি সরকার বিহারে লালু প্রসাদ যাদব ও তেজস্বী যাদব এবং ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সরেনের বিরুদ্ধে ইডি হামলা তীব্রতর করেছে।

বিহারে বিজেপির ক্ষমতা দখলের ছকের পেছনে আরেক প্রধান কারণ হল বিহারের অনুপ্রেরণায় গণতন্ত্র এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন‍্যায়ের লড়াই জনপ্রিয় চেহারা নিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সঙ্ঘ বাহিনীর আশঙ্কা। বিহারে জাতজনগণনা ও আর্থসামাজিক সমীক্ষা দেশজুড়ে আগ্রহের জন্ম দিয়েছে এবং সর্বভারতীয় স্তরে জাতজনগণনা চালানোর ও বর্ধিত সংরক্ষণের দাবি তোলার ভিত্তি হয়ে উঠেছে। বিহারে বিপুল মাত্রার দারিদ্র‍্যের দিকে দৃষ্টি ফেরানো, দারিদ্র দূরিকরণের জরুরিভিত্তিক কর্মসূচীর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা এবং সরকারি চাকুরির ব‍্যবস্থা ও বিহারের যুবসমাজের ভবিষ‍্যৎ সুরক্ষিত করার দিকে নজর কেন্দ্রীভূত করা হয়। ভালো সংখ‍্যক শিক্ষক নিয়োগ অন‍্যান‍্য সরকারি শূণ‍্যপদে নিয়োগের আশা জাগায়। বিজেপি এই এজেণ্ডাকেই থামিয়ে দিতে এবং জনগণের অধিকার ও কল‍্যাণের অভিমুখ থেকে জনতার মনযোগকে বিদ্বেষপূর্ণ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের দিকে ঘুরিয়ে দিতে মরিয়া ছিল।

আমাদের অবশ‍্যই স্মরণে আনতে হবে যে এনডিএ ২০১৯এর নির্বাচন ঝড়ের গতিতে জিতলেও তার কয়েক মাসের মধ‍্যেই বিরোধীপক্ষ বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। বিহারের মহাজোটে সিপিআই(এমএল)-র প্রবেশ বিহারের কোটি কোটি বঞ্চিত নিপীড়িত জনতার সামাজিক ঐক‍্য প্রসারিত করে এবং রাজনৈতিক উত্থান জোরদার করে, এনডিএ খুবই স্বল্প ব‍্যবধানে কোনোরকমে ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। নীতিশ কুমারের ফিরে যাওয়াটা বিজেপির আগ্রাসী বাগাড়ম্বরের পেছনের প্রকৃত দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে এবং এটার ফলে এনডিএ শিবিরের আভ‍্যন্তরীণ টানাপোড়েন বৃদ্ধি পাওয়া অবশ‍্যম্ভাবী। অন‍্যদিকে মহাগঠবন্ধন এখন আরো ঐক‍্যবদ্ধতা, দৃঢ়তা ও শক্তির সাথে এগিয়ে যেতে পারবে। ২০২০র বিধানসভা নির্বাচনের পর এবং সাম্প্রতিক জাতজনগণনা, আর্থসামাজিক সমীক্ষা ও শিক্ষক নিয়োগের মধ‍্যে দিয়ে যে আশা ও উদ‍্যম জেগেছে তাকে অবশ‍্যই পালনপোষণ করতে হবে এবং বিজেপির এই ক্ষমতা দখল ও নীতিশের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে যে গণক্ষোভ জেগেছে তাকে প্রবাহিত করতে হবে আসন্ন নির্বাচনে বিহারে ইণ্ডিয়া জোটের আরো শক্তিশালী উত্থানের অভিমুখে।

সূত্র: এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৩১ জানুয়ারি ২০২৪

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও