ভারতে ধর্মীয় অসহিঞ্চুতা ও সাম্প্রদায়িকতার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে ফের মুখর অমর্ত্য সেন। রবিবার কলকাতায় প্রতীচী ট্রাস্টের এক অনুষ্ঠানে তাঁর মন্তব্য, “ধর্ম নিয়ে লোকেদের মারধর করা হচ্ছে, এবং তাদের বক্তব্য কী শুনতে আমাদের আপত্তি হচ্ছে, ভারতে এরকম অবস্থা তো খুব বেশি দিন চলেনি।” নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের কথায় “দেখতে হবে, কেন আমরা এতটা পিছিয়ে পড়েছি। তার একটা কারণ সম্ভবত লোকের প্রতিদিন মার্জনা করার যে ক্ষমতা, তা অনেকটাই কমেছে।”
শনিবার কলকাতায় পা রেখেছেন অমর্ত্য সেন। এদিন সকালে প্রতীচী ট্রাস্টের ‘যুক্তসাধনা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটানোর পথ জানতে প্রশ্ন করেন এক স্কুল-ছাত্রী। জবাবে তিনি দেশে গত কয়েক বছরের হিংসা, হানাহানি ও ধর্মীয় অসহিঞ্চুতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। অমর্ত্য বলেন, “ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের ইতিহাস যদি আমরা দেখি, দুটো জিনিস দেখতে হবে। একটা হচ্ছে যে, বিভিন্ন দলের মধ্যে যে ঝগড়াঝাঁটি, যে বিরোধ, তার কারণ কোথায় নিহিত? কী কারণে এখন দেশে এমনটা হচ্ছে, তা দেখতে হবে।” এর প্রতিকারের পথ বাতলাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “একটা হচ্ছে যে, বিভিন্ন দলের মধ্যে সমতা আনার প্রয়োজন।” কয়েক মাস আগে দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাপ্রাপ্ত হওয়া নিয়ে তোপ দাগতে শোনা গিয়েছিল ৮৯ বছরের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে। ইদানীংকালে এদেশে ধর্মীয় দার্শনিকতার যে একমাত্রিক ঝোঁক দেখা গিয়েছে, তার বিরুদ্ধেও সরব হয়েছেন তিনি। তাঁর ‘পরিচিতি ও হিংসা’ নামক গ্রন্থে অমর্ত্য বলেছেন, ‘এ হল সত্তার সঙ্কট এবং সত্তার পারস্পরিক সংঘাত। অন্যের সত্তাকে তার পরিসরটুকু দিতে না চাওয়া, সেটাই হল মূল সমস্যা। লিভ অ্যান্ড লেট লিভ! এই দার্শনিক বহুত্ববাদী প্রত্যয়ের শিকড় নিয়েই আসলে টানাটানি।” এদিন তাঁর কথায়, এদেশে এই যে এক পক্ষের কথা সবাইকে শোনানোর ধারা শুরু হয়েছে, তা ভারতীয় সামাজিক দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্যময় নয়।
এদিনের অনুষ্ঠানে মূল বিষয় ছিল হিন্দু ও মুসলমানের পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি। এ প্রসঙ্গে ‘ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সাধনা” নামে অমর্ত্য সেনের মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেনের একটি প্রবন্ধ সংকলনের বিভিন্ন অংশ পাঠ করেন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক বিশ্বজিৎ রায়। ক্ষিতিমোহনের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির ভাবনা নিয়ে বক্তব্য রাখেন তাঁর প্রপৌত্র শান্তভানু সেন। দু’জনেই জোর দেন সমাজ, শিল্প ও সৃজনক্ষেত্রে এ দেশে দুই ধর্মের একযোগে পথ চলার পরম্পরার উপর। এ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রচরিত্রে ‘বিচিত্র’ ও ‘বৈচিত্র’-র সহাবস্থানের উল্লেখ করেন। বলেন, “ডি এল রায় তাঁর নাটকে আলেকজান্ডারের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন ‘সত্য সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ।’ এই বিচিত্রতা আর বৈচিত্রের উপরই জোর দিতে হবে।
বৈচিত্র্য নিয়ে অমর্ত্য সেনের বক্তব্য, “দেশে কেউ খেতে পাচ্ছেন আর কেউ পাচ্ছেন না, বা কেউ শিক্ষালাভের জন্য বিদ্যালয়ে যেতে পারছেন, কেউ পারছেন না, এটাও তো বৈচিত্র? কিন্তু এই বৈচিত্র কি কাম্য। তাই আমি এটা বলব যে, বৈচিত্রের প্রশংসা ও বৈচিত্রের সমস্যা, এই দুটোকেই ভেবে দেখা প্রয়োজন।”
এদেশে হিন্দু ও মুসলমান, এই দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্কের পরম্পরার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এদিন একাধিকবার মুঘল সম্রাট শাজাহানের পুত্র দারাশুকোর কথা টানেন তিনি। বলেন, দারাশুকোই উপনিষদকে গোটা পৃথিবীর কাছে পরিচিত করেন। সংস্কৃত থেকে প্রথম পার্সি ভাষায় তিনি উপনিষদ অনুবাদ করেন। সেই অনুবাদ থেকেই পরবর্তীকাল জার্মান ও ইংরেজি ভাষায় উপনিষদের অনুবাদ করা হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সময় হিন্দু শিল্পী- সাহিত্যিকদের প্রাধান্যের কথাও মনে করান তিনি। মনে করিয়ে দেন, তাজমহলের স্থপতিদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু।