হে ইমামগণ!! আপনাকে বলছি——-

আলমগীর সরদার:

গতকাল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে গেস্ট হিসেবে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। কিন্তু যায়নি। না যাওয়ার কারণ ছিল বহুবিধ- ছিল চিন্তার দোলাচল। কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েও পড়েছিলাম। কারণ হিসেবে বলা চলে, দু-চার বছর আগে বর্তমান সরকার সম্পর্কে মুসলিমদের মধ্যে যে উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল; তা বঞ্চনা, উদাসীনতা আর দুর্নীতি নামক ভাটার টানে গ্রাফ অনেকটা নিচে নেমে এসেছে। সীমাহীন অসন্তোষ জমে উঠেছে সচেতন মুসলিমদের মধ্যে। তাছাড়া এটাও ভেবেছিলাম যে, সম্মেলনটা হচ্ছে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ব্যানারে, কিন্তু সেখানে তারা মর্যাদা পাবেন তো! সেখানকার সমস্ত আলো রাজনীতিবিদরা কেড়ে নেবেন না তো! এই দোলাচলে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি।

যাইহোক- ভিডিওতে দেখলাম, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বক্তব্য শুরু করলেন। ইমাম সাহেবরা চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে ছিলেন, কখন আসবে সেই মহেন্দ্রক্ষণ! কখন তিনি ঘোষণা করবেন- ভাতা আড়াই থেকে কমপক্ষে পাঁচ করা হলো। বক্তব্য চলছে তো চলছেই, শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে একঘেয়েমি চলে এসেছে, তবুও শুনতে হচ্ছে, কারণ মুখ্যমন্ত্রী বলে কথা। বক্তব্যের একেবারে অন্তিম পর্যায়ে এসে তিনি পাঁচে প্যাঁচ লাগিয়ে দিলেন। পাঁচের ঘোরে কিছু ইমাম করতালিতে ধন্য করলেন তাঁকে। কিন্তু সচেতন ইমামগুলি ততক্ষণে পাঁচের প্যাঁচ কাটিয়ে গ্যালারি ছাড়তে শুরু করলেন। একরাশ ক্ষোভ আর অভিমান ঝরে পড়ল তাদের মুখনিঃসৃত বাণীতে। আর কিছুক্ষণ আগে যারা করতালিতে মুখরিত হয়েছিলেন; সম্বিত ফিরলে তারাও ভাবলেন, সর্বনাশ! হলো টা কি! তখন তারাও শামিল হলেন ক্ষোভ সাগরে ভাসতে।

আচ্ছা; এই ভাতা কি ইমামদের অধিকার, নাকি তাদের প্রতি করুণা? অধিকার যদি হয়, তাহলে মনে রাখবেন- তা আদায় করে নিতে হয়। আর আদায় করতে গেলে লাগে জনবল; সেটা ইমামদের আছে কী? নেই। অথচ এই ইমামরা এক সময়ে ছিলেন সমাজের তাজ, আর সেই তাজ ধুলির ধারায় ভূলুণ্ঠিত আজ। বিগত দিনে যারা ভিক্ষা দিয়েছেন, আজ তাঁদের হাতেই ভিক্ষার ঝুলি! কি নিদারুণ ইতিহাস আজ আমাদের। ভাবতে অবাক লাগে, চোখ ছলছল করে ওঠে।। আর কতদিন? কেন এই দৈনদশা আমাদের? তা ভেবেছেন কি?

সরকার দিল, কি দিলো না, তা নিয়ে আমি খুব বেশি ভাবিত নই। কারণ তাদেরও রাজনীতির বাধ্য ব্যাপকতা আছে, যা আমরা সবাই বুঝিনা। এমতাবস্থায় আমাদের প্রতিবন্ধকতাটা ঠিক কোথায়? সরকার, না আমরা? যদি সরকারকেও দোষ দিই, তাহলেও কিন্তু সেই দোষ আমাদের ঘাড়ে বর্তায়। কেন জানেন? আমরা আমাদের নেতা নির্বাচন করতে পারিনি। প্রকৃতপক্ষে আমরা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন। আর আমাদের মধ্যে আছে বিভেদের প্রাচীর, যা প্রতি পদেপদে আমাদেরকে গ্রাস করে রেখেছে। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়, যখন শুনি ৬৫র অধিক ইমাম সংগঠন আছে পশ্চিমবাংলায়। ভাবতে থাকি- কোরআন এবং হাদিস এই ইমামদেরকেও কি এক করতে পারলো না? এক যদি না হয় তাহলে অধিকার বুঝে নেবে কিভাবে?

যাইহোক- ইমামদের ভাতা দিয়ে মুসলিম সমাজের কি উপকার হয়ছে তা আমি ঠিক জানি না! তবে জানামতে ইমামরা যে তিমিরে ছিলেন, সে তিমিরেই রয়ে গেছেন। কারণ বহুবিধ। অধিকাংশ সমাজ ইমামদের প্রতি সুবিচার করেন না। ইমামদের প্রতি তাঁদের বঞ্চনার শেষ নেই। অধিকাংশ জায়গাতে ইমামদের ভাতা সরকার যতটুকু দিয়েছে, কমিটি কমিয়েছে ঠিক ততটাই। এমনকি বহু জায়গায় যারা ইমামতি করেন তাদের নামে ভাতা পর্যন্ত চালু নেই, আছে অন্য জনের নামে। তাহলে প্রশ্ন আসে ইমামরা এই টাকার মুখাপেক্ষী কেন? আমার যতটুকু মনে হয়, অধিকাংশ ইমামরা ভাবেন- সরকারি খাতায় একবার নাম উঠলে বহু সুযোগ সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। এ ধারণা থেকেই হয়তো তাঁরা উৎসাহ উদ্দীপনা পায়। তবে মনে রাখবেন- সে গুড়ে কিন্তু বালি।

ইমামদের বলবো, ইমামতি করাটা পেশা হিসেবে নিলেন কেন? মনে রাখা দরকার, পেশা হিসেবে কারও কাছ থেকে কিছু নিলে তাদের প্রতি আনুগত্য দেখাতে হয়। তাছাড়া মনের অজান্তেই তাদের প্রতি আনুগত্যর অভ্যাস গড়ে ওঠে, চাই সে সমাজ হোক, আর সে হোক সরকার। ফলে তাঁদের আনুগত্য করতে করতে- আল্লাহর পরিবর্তে মানুষের গোলামে পরিণত হয়েছেন আপনারা। যার ফলে মসজিদের মেম্বার থেকে শিরিক-বিদআত, সুদ-ঘুষ-যেনা-ব্যভিচার আর মদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠে আওয়াজ তুলতে পারেন না। কারণ, উক্ত দোষে দুষ্ট অধিকাংশ মুসলিম সমাজ এবং সরকার। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে ইমামতিটা চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। সে জন্য মুখে রিজিকের মালিক আল্লাহ বললেও হৃদয়ে পোষণ করেন অন্য কিছু। প্রকৃতপক্ষে ইমামদের হক কথা বলার অন্তরায় হল জীবিকা। সে জন্য জন্য বহু ইমামদের বলেছি জীবিকার জন্য অন্য কিছু করুন। এমনকি বলেছি, কমপক্ষে একটা হোমিওপ্যাথি মেটেরিয়া মেডিকা কিনুন। তা নিয়ে চর্চা করুন, দেখবেন ইমামতির চাইতেও বেশি ইনকাম হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আজ পর্যন্ত কাউকেই এ কথা মানতে দেখলাম না। প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ ইমামরা খুবই অলস প্রকৃতির। যার ফলে এক সপ্তাহ সময় থাকলেও ভালো একটি খুতবা সমাজকে উপহার দিতে সক্ষম হন না। আর এই অক্ষমতার ফলে সমাজ জীবনে তাদের মূল্যায়নের চেয়ে অবমূল্যায়নই হয় বেশি। মাঝে মাঝে মনে হয় তাদের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে পরাধীনতার স্বাদটাই যেন বেশি। সেজন্য সামান্য অর্থের প্রয়োজনে আজ ইমামদের ফ্যালফ্যাল করে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। আফসোস আমাদের।

দ্বিতীয়ত আমাদের শত্রু আমরাই। আমরা মানে? সাধারণ জনগণ। মুখে আমরা আল্লাহ ও রসূলের ভালোবাসার কথা বললেও হৃদয়ে থাকে অন্য কথা। প্রকৃতপক্ষে আমরা এখানে নিখুঁত অভিনয় করে চলেছি। কোরআন হাদিসের অপমান আমরা সহ্য করতে পারিনা বটে। কিন্তু কুরআন হাদিস জানা ব্যক্তিদের অপমান করতেও আমরা ছাড়ি না। একদিকে অন্তহীন ভালোবাসা, অন্যদিকে উপেক্ষা। সেজন্যই তো আজও মসজিদের ইমাম খোঁজা হয় তিন থেকে চার হাজার টাকার বিনিময়ে! কেন এই দ্বিচারিতা? মনে রাখা দরকার- মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো সম্ভবনাময় শিল্পে বিনিয়োগ করা। একজন পিতা সন্তানকে প্রতিপালন করেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। কারণ সেই-ই তাঁর সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। স্বপ্নের সন্তান যদি ইমামতি করেন তাহলে তিনি কি তার পিতার প্রতি কর্তব্য পালন করতে পারবেন? উত্তর আসবে যথার্থভাবে সম্ভব নয়। কারণ সর্বসাকুল্যে তার ইনকাম মাত্র সাত থেকে আট হাজার টাকা। যা দিয়ে নিজের সংসার চালানোটাই কষ্টকর হয়ে যায়। এমতাবস্থায় কোনো সচেতন গার্জিয়ান কি চাইবেন তার সন্তান ইমামতি করুন! সেজন্য দেখা যায় অধিকাংশ ইমাম সহ সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়াতে চান না। আচ্ছা! আমরা কি পারি না, সমাজের ইমামদেরকে যথার্থভাবে সুখী রাখতে। ইমামরা যদি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সুখে থাকে তাহলে প্রতিভাবানরা এবং বর্ধিষ্ণু পরিবারের সন্তানরাও ইমামতি করতে চাইবে। আর যদি এ ধারা অব্যহত থাকে তাহলে আমরা ঘোর অমানিশায় ডুবতে থাকবো। তাই আসুন সরকার না দিলেও এক একজন ইমামকে আমরা কমপক্ষে পনের হাজার টাকা করে ভাতা দিই। যদি দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে বর্তমানে না হলেও আগামীতে একটি সুন্দর সমাজ আমরা পেতে পারি, যেখানে যোগ্য আলেম তৈরি করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হবে। সমাজ উপকৃত হবে।

পরিশেষে বলি- সরকারের কাছে চাওয়া পাওয়া সহ এবং সমাজ জীবনেরও বহু সমস্যার মূলে আছে মুসলিম নেতারা। হোক সে রাজনীতির অথবা ধর্মীয়। ধর্মীয় নেতারা চায় না এক হতে, আর রাজনীতির নেতারা চায় জাতি গোল্লায় গেলেও নিজের স্বার্থসিদ্ধি উদ্ধার করতে। এই সমস্যার উত্তরণের পথ হতে পারে ইমামরা। ইমামরা যদি জেগে উঠে তাহলে অনেক কিছুর সমস্যা সমাধান সম্ভব। কোনও দল তোমার উপর চাপিয়ে দেওয়া নেতা নয় বরং ইমামদের দ্বারা মনোনীত ব্যক্তিই হোক রাজনৈতিক নেতা। তাহলেই জাতির কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সর্বত্র বলতে পারবে, নতুবা মুসলিম নেতারা তাদের দলীয় নেতা-নেত্রীদের পদলেহন করতে করতেই জীবন অতিবাহিত করবে। আর তোমাকে নিয়ে অন্যরা চিরজীবন ফুটবল খেলবে। আর তারা মনে করবে তোমরা তাঁদের করুনায় বেঁচে আছো। তাই, আর নয়- জেগে ওঠো।
হে ইমামগণ! তোমার হাত ধরেই ভারত পেয়েছিল স্বাধীন সূর্য, কিন্তু তুমি আজ অস্তমিত কেন? জেগে উঠো, তোমার দায়িত্ব অনেক। আর ঘুমানো নয়। জেগে থাকার অভ্যাস গড়ে তোলো, জাগিয়ে রাখার অভ্যাস গড়ে তোলো। তোমার হাত ধরেই উদিত হোক জাতীর সোনালী সূর্য। মনে রেখো- তুমি ঘুমিয়ে আছো বলেই, সবাই জেগে আছে। আর তুমি জেগে উঠলে, সবাই তখন ঘুমাবে। সে প্রত্যাশায় রইলাম।
(জমিয়তে আহলে হাদীসের রাজ্য সম্পাদক আলমগীর সরদার এর ফেসবুক ওয়াল থেকে)

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও