ভোট-প্রচার থেকে বিশ্ব কাপ: ক্রমশ হতাশা বাড়ছে মোদী-শাহের

 

ভারতের প্রভাবশালী মিডিয়া নভেম্বর, ২০২৩ এর প্রথম তিন সপ্তাহ জুড়ে শুধু দু’টি প্রচার চালিয়েছে : ছত্তীশগড়, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন আর ৪৬ দিন ব্যাপী ওডিআই বিশ্ব কাপ যা ৫ অক্টোবর শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ১৯ নভেম্বর। দুটি ম্যাচের খেলাই হয়েছিল আহমেদাবাদের পুরোনো সর্দার প্যাটেল স্টেডিয়ামে, মোদী সরকার যার নতুন নামকরণ করেছে নরেন্দ্র মোদীর নামে। গাজায় নারী, শিশু নির্বিশেষে নিরস্ত্র প্যালেস্তিনীয়দের হত্যার যে বিরামহীন জাতিনিধন পর্ব চলেছে, তা অবশ্য কখনোই ‘সংবাদের’ মর্যাদা পায়নি গোদী মিডিয়ায়। এমনকি, উত্তরাখণ্ডে সুড়ঙ্গ বিপর্যয় যার দরুন এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন একচল্লিশ জন শ্রমিক, সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাতেও বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার সময় পায়নি এই মিডিয়া!

এই নির্বাচনী প্রচারেও অবশ্য দ্বিচারিতা আছে। ৭ নভেম্বর ছত্তীশগড়ে নির্বাচনের ঠিক আগে ইডি- সৌজন্যে বিরাট ‘ব্রেকিং নিউজ’ – পদাসীন কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল ৫০০ কোটি টাকারও বেশি একটি বেটিং অ্যাপ কেলেঙ্কারিতে জড়িত! সেই চিল-চিৎকৃত শিরোনামের পর অবশ্য খবরে জানা গেল, অভিযোগের তদন্ত চলবে। বেটিং অ্যাপের বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারের নির্দেশে বেশ কিছুদিন ধরেই তদন্ত চলছে এবং বেশ কয়েক জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। ঐ ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর সময়টি অব্যর্থভাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ছত্তীশগড় নির্বাচনের জনমত ও ভোট-পছন্দকে প্রভাবিত করার স্পষ্ট উদ্দেশ্যে। ইডিকে হাতিয়ার করার ব্যাপারটা অবশ্য ছত্তীশগড় ও রাজস্থানে একেবারে নতুন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ঐ একই সময়ে প্রচারিত আরও দু’টি বড় খবর কিন্তু তুলে এনেছে ভিন্ন ছবি। রাজস্থানে স্টেট
অ্যান্টি – করাপশন ব্যুরো ঘুষ নেওয়ার সময় হাতে নাতে ধরে ফেলে দুই ইডি অফিসারকে। কিন্তু সেই স্টোরিটি খুব দ্রুত উধাও হয়ে যায় মিডিয়া থেকে। আরও সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কৃষিমনূত্রী নরেন্দ্র সিং তোমরের পুত্র দেবেন্দ্র সিং তোমরের কয়েকটি ভিডিও সমাজ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে যেখানে তাকে কোটি কোটি টাকার কমিশন ঠিক করা নিয়ে টেলিফোনে কথাবার্তা চালাতে দেখা গেছে। এই ধরণের দুটি ভিডিও-র প্রথমটিতে ১০০ কোটির এবং দ্বিতীয়টিতে ২৫০ কোটি টাকার প্রথম মাসিক কিস্তির কথা বলতে দেখা যাচ্ছে; এরপর তৃতীয় ভিডিও-তে কানাডার অ্যাবটসফোর্ড থেকে জনৈক জগমনদীপ সিং কে দাবি করতে দেখা যাচ্ছে তিনিই নাকি আগের ভিডিওগুলোয় আর্থিক লেনদেন নিয়ে দেবেন্দ্র সিং তোমরের সঙ্গে কথা বলা সেই ব্যক্তি। প্রথম দু’টি ভিডিও সম্ভবত আরও আগের, প্রথম মোদী মন্ত্রীসভার সময়কার, যখন নরেন্দ্র সিং তোমর খনিমন্ত্রী ছিলেন। দ্বিতীয়বারের মন্ত্রীসভায় কৃষিমন্ত্রী হওয়ার আগে।

জগমনদীপ সিং আরও বিশদ তথ্য সংগ্রহের জন্য তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তার বয়ান থেকে ১০,০০০ কোটি টাকার এক বিরাট, জটিল ষড়যন্ত্রের কথা জানা যাচ্ছে যাতে তোমর-রা কমিশন নেওয়া ও কানাডায় মারিজুয়ানা চাষে টাকা ঢালার অভিযোগে জড়িত আছেন। মধ্যপ্রদেশ নির্বাচনে যে ৭ জন সাংসদকে বিজেপি বিধায়ক পদে প্রার্থী করেছে, নরেন্দ্র সিং তোমর তাদের মধ্যে একজন। অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে বিজেপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব, কেন্দ্রীয় অনুসন্ধানকারী সংস্থা এবং নির্বাচন কমিশনের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা সকলেই এখনও এক প্রস্তরীভূত নিস্তব্ধতা বজায় রেখেছেন, আর উচ্চকণ্ঠ প্রভাবশালী মিডিয়াও খবরটি একেবারে হজম করে ফেলেছে! বাঘেল আর তোমরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের প্রতি মিডিয়ার প্রতিক্রিয়ায় এই আশ্চর্য বৈপরীত্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, প্রভাবশালী বৃহৎ মিডিয়া সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতাসীনের প্রচারযন্ত্র ও রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে!

নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক নির্বাচনী ভাষণগুলো বিজেপি’র নির্বাচনী প্রচারে যুগপৎ রাজনৈতিক হতাশা ও হীনতাকে উত্তরোত্তর প্রকট করে তুলছে। ২০২০র ফেব্রুয়ারিতে দিল্লীর বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে ভাষণ দিতে গিয়ে কী বলেছিলেন অমিত শাহ আর অনুরাগ ঠাকুর? অমিত শাহ ভোটারদের বলেছিলেন শাহীনবাগকে বিদ্যুতের শক
দিতে আর অনুরাগ ঠাকুর ‘বিশ্বাসঘাতক গদ্দারদের’ গুলি করে মারতে চেয়েছিলেন। সেই নিদর্শ বা মানকে অনুসরণ করে মোদী ভোটারদের বলেছেন, কংগ্রেসকে ফাঁসিকাঠে চড়ানোর মেজাজ নিয়ে ইভিএম-এ পদ্ম- বোতাম টিপতে! নির্বাচন কমিশন বিজেপি’র নির্বাচনী প্রচারে প্রকাশ্যে এইধরণের হিংসার আগুন জ্বালিয়ে তোলা এবং অন্যান্য নির্বাচন বিধি নির্লজ্জভাবে লঙ্ঘনের অভিযোগের প্রতি যথারীতি বধির থাকাই শ্রেয় মনে করছে। অবশ্য ক্রিকেট বিশ্বকাপ ঘিরে বিজেপি’র নির্বাচনী প্রচারের পরিকল্পনা এক বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। ভারতীয় টীমের লীগ পর্যায়ে এবং সেমি ফাইনালে টানা দশবার জেতার পর ফাইনালে অভাবিত পরাজয় সেই ধাক্কার কারণ।

ক্রিকেটের রাজনীতিকরণ (ক্রিকেটকে রাজনীতির ক্রীড়নক বানানো) মোদী জমানায় এক অভূতপূর্ব কুৎসিত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিসিসিআই আইপিএল কেলেঙ্কারিরতে যিনি মূল অভিযুক্ত এবং বসুন্ধরা রাজের (পূর্ববর্তী) আমলে যিনি রাজস্থানের ‘সুপার চীফ-মিনিস্টার’ নামেই পরিচিত ছিলেন, সেই ললিত মোদীকে দেশ ছেড়ে পালাতে দেওয়ার পর বিজেপি মহা আহ্লাদে এবং অবলীলায় অমিত শাহ’র ছেলে জয় শাহকে বিসিসিআই-এর মাথায় আর অনুরাগ ঠাকুরের দাদা অরুণ সিং ধুমলকে আইপিএল-এর চেয়ারম্যান পদে বসিয়েছে। এই গোষ্ঠীটি সাম্প্রতিক ক্রিকেট বিশ্বকাপ, যেখানে ক্রিকেট দুনিয়ার দশটা দেশ অংশ নিয়েছিল, তাকে কার্যত সাত-সপ্তাহের এক ভারত-কেন্দ্রিক, থুড়ি, আমেদাবাদ-কেন্দ্রিক মহোৎসবের প্রদর্শনীতে পরিণত করেছিল। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ এবং ফাইনাল ম্যাচ – দু’টিরই খেলা হয়েছিল আমেদাবাদে। আর পাক দলকে উপলক্ষ্য করে তীব্র সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র ‘দেশভক্তি’র জিগির তুলে হেনস্থার শিকার করা হয়েছিল তাদের। এমনকি, ফাইনাল ম্যাচের দিনও গোটা শো’টা ভারতীয় দলের জেতার আগাম প্রত্যাশা নিয়েই পরিকল্পিত হয়েছিল। সেদিন বিজয়ী অস্ট্রেলীয় দল বা তার খেলোয়াড়দের তাই কোন সৌজন্য দেখানো বা অভিনন্দন জানানোও হল না! আগামী ২০৩৬ এর অলিম্পিকের আয়োজক ভারত যদি ঐ ব্যাপারে গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, সেক্ষেত্রে ক্রিকেট বিশ্বকাপ ইউপি ভারতের ক্রীড়া সংস্কৃতি বা তার চরম অভাবের এক বিপর্যয়কর, শোচনীয় ও লজ্জাজনক বিজ্ঞাপন হয়ে রইলো!

এম এল আপডেট, ভাষান্তরঃ দেশব্রতী

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও