সাচার কমিটি রিপোর্ট: একটি সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু

ড: নুরুল ইসলাম

ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় পিছিয়ে পড়া একটি জনগোষ্ঠী। তাদের পিছিয়ে পড়ার বা পিছিয়ে রাখার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। বস্তুত কোনো দেশের রাজনৈতিক শক্তি সেই দেশের বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর ভাগ্য নিয়ামক। এদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে। মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাগ্য বিপর্যয়ে রাজনৈতিক অনুষঙ্গ কত প্রভাবশালী সেটা এখানে দেখার চেষ্টা করব।

১৭৫৭ সাল। ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল। পালাবদল ঘটে এদেশের দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার। সুদূরপ্রসারী তার প্রভাব। বস্তুত রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের প্রভাব কখনো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না। এদেশে আর্যদের আগমন হোক অথবা মুসলিমদের আগমন হোক অথবা খ্রিষ্টানদের আগমন প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের আগমন ও আগ্রাসন এদেশের মাটিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে। যা কখনো মুছে যায়নি । কখনো মুছে যাবে না।

খ্রিষ্টান ঔপনিবেশিক শক্তি এদেশে তাদের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুদৃঢ় করতে একটি সুদূরপ্রসারী নীতি গ্রহণ করে। ‘ভাগ কর, শাসন কর।’ এই ঔপনিবেশিক শক্তির শত্রু ছিল ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়। কারণ মুসলিমদের ক্ষমতাচ্যুত করে তারা ক্ষমতাসীন হয়েছে। এই পালাবদলে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। তবে তারা যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ তাই তাদের গুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না। যদিও রাজতন্ত্রে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু খুব একটা ম্যাটার করে না। যাই হোক।

খ্রিষ্টান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের শাসনকে সুদৃঢ় করতে এদেশে একটি শ্রেণিকে কাছে টেনে অন্য সম্প্রদায়কে দূরে সরিয়ে দেওয়ার পলিসি গ্রহণ করে। এভাবে তারা এদেশের মানুষের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষের চাষ শুরু করে। যার ফসল সাম্প্রদায়িকতা। ঘৃণা, বিদ্বেষ ও দাঙ্গা। ঔপনিবেশিক শক্তি প্রথম একশো বছর হিন্দু তোষণ ও মুসলিম দমনের রাজনীতি করে। যার পরিণতি, মুসলিম মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির চুড়ান্ত অধঃপতন।

১৮৬৭ সাল। সরকারি আধিকারিক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার মুসলিম সম্প্রদায়ের অধঃপতনের কারণ অনুসন্ধান করেন। তাঁর গবেষণা সন্দর্ভ Indian Musalman শিরোনামে গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়। সরকারি পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি সমকালীন মুসলিম সম্প্রদায়ের অধঃপতনের প্রামাণ্য দলিল পেশ করেন। উঠে আসে মুসলিম সম্প্রদায়ের চরম দুর্দশার ছবি। রাজদ্রোহের চরম শাস্তি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর মুসলিম সম্প্রদায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করে। আলিগড় আন্দোলনের স্পিরিট ভারত উপমহাদেশের মুসলিম চিন্তা ও চেতনায় নাড়া দেয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা বন্ধ করে। আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে শুরু করে। একই সঙ্গে দেওবন্দ আন্দোলন মুসলিম জনমানসে নাড়া দেয়। এই সব নতুন সংস্কার আন্দোলন আসমুদ্র ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে। মুসলিম সম্প্রদায় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতার মাত্রা কমিয়ে শুরু করে সমাজ পুনর্গঠনের উদ্যোগ। ফলে শুরু হয় এক নতুন পর্ব। এই পর্যায়ে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সরকারি চাকরি ও ব্যবসা বাণিজ্যে মুসলিম সম্প্রদায় তাদের হিস্সা দাবি করতে শুরু করে। শুরু হয় পারস্পরিক প্রতিযোগিতা । পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ। যার পরিণতি, অবিশ্বাস, ঘৃণা, দাঙ্গা ও দেশভাগ।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাভাবিকভাবেই বিভাজিত ভারতে মুসলিম সম্প্রদায় হয়ে পড়ে অনাথ। নেতৃত্বহীন। চরম ঘৃণা ও বিদ্বেষের শিকার। শুরু হয় বঞ্চনার নতুন মাত্রা। বঞ্চনা ও বৈষম্যের নতুন যুগ। ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম একশো বছর মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার যে আচরণ করেছে। প্রায় অনুরূপ, স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভারত সরকার অঘোষিত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো আচরণ শুরু করে। প্রতি বছর হাজার হাজার মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অবলীলায় চলতে থাকে সরকারি বৈষম্য। ধারাবাহিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে চলতে থাকে সামাজিক বয়কট, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও রাজনৈতিক প্রান্তিকিকরণ। এমনকি স্বাধীন ভারতে মুসলিম সম্প্রদায় প্রথম দিন থেকে নিরবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তাহীনতার শিকার। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ তাদের জন্য সীমাবদ্ধ। ব্যবসা ও বাণিজ্যে তাদের বিরুদ্ধে অঘোষিত অবরোধ। রাজনীতিতে তাদের অবস্থান লোকদেখানো। এখন শুরু হয়েছে মুসলিম মুক্ত রাজনীতি। এই মুহূর্তে প্রায় কুড়ি পঁচিশ কোটি জনসংখ্যার মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো প্রতিনিধি নেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায়। ভয়ানক দুঃসাহস! এই মুহূর্তে এদেশের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি মুসলিম বিরোধিতা। যে দল ও যে ব্যক্তি যত বেশি মুসলিম বিরোধী । সে ব্যক্তি ও দল তত বেশি জনপ্রিয়। ভয়ানক! ভয়ঙ্কর! এই উন্মাদনার পরিণতি কী হবে, কেউ জানে না। সব কিছু হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

বস্তুত গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে ভারতে মুসলিম বিরোধী রাজনীতি নতুন মাত্রা পেতে শুরু করে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন দুর্বার গতিতে চলতে শুরু করে। রামমন্দির ও রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হিন্দু জনমানসে উন্মাদনা সৃষ্টি করে। এই উন্মাদনা কিছু দিনের মধ্যে এদেশের রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠে।

এই শক্তির উপর ভর করে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি নব্বইয়ের দশক থেকে ক্ষমতার স্বাদ পেতে শুরু করে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের শিরোপা অর্জন করে। ক্ষমতাসীন দলে পরিণত হয়। কোয়ালিশন দলের প্রধান শক্তি রূপে ক্ষমতাসীন হয়। হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়।

২০০৪ সালের নির্বাচনে হিন্দুত্বের উন্মাদনা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এই সময় দীর্ঘ অবদমিত মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষে তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ বঞ্চনার অভিযোগ জোরদার হয়। মনমোহন সিংয়ের সরকার দিল্লী হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সমীক্ষা করার দায়িত্ব প্রদান করে। এই কমিটি ২০০৬ সালে তাদের গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন সরকারের নিকট পেশ করে। সরকারি দলিল।

কমিটির প্রতিবেদনে মুসলিম সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থার চরম দুর্দশার চিত্র প্রকাশ পায়। মুসলিম সম্প্রদায় দেশের এস সি ও এস টি সম্প্রদায়ের থেকেও পিছিয়ে পড়ার ছবি উঠে আসে। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের চরিত্র উন্মোচিত হয়। সরকারি প্রামাণ্য দলিল এই প্রতিবেদন। এই কমিটির সুপারিশ মেনে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সদিচ্ছা থাকলেও কংগ্রেস তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

২০১৩ সালে মনমোহন সিং সরকার সাচার কমিটি রিপোর্টের উপর গৃহীত ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হয়েছে তা সমীক্ষার জন্য অধ্যাপক অমিতাভ কুন্ডুর নেতৃত্বে একটি ওয়ান ম্যান কমিটি গঠন করে। শ্রী কুন্ডুর প্রতিবেদনে সরকার ও আমলাদের অবজ্ঞা ও অবহেলার নির্লজ্জ ছবি উঠে আসে। বস্তুত সাচার কমিটি রিপোর্ট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাগ্য পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

২০১৪ সাল। মনমোহন সিংয়ের সরকারের পতন হয়। শ্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার পর থেকে শ্রী নরেন্দ্র মোদী হিন্দুত্বের পোষ্টার বয় রূপে সমাদৃত হন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতি অভূতপূর্ব শক্তি অর্জন করেছে। তাঁর নেতৃত্বে বিজেপি এখন মুসলিম মুক্ত দল। মুসলিম মুক্ত তাঁর মন্ত্রীসভা। অনেকেই বলছেন, দেশে এখন মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। অস্বাভাবিক অবস্থা। উন্নয়নের পরিবর্তে মুসলিম সম্প্রদায় এখন নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তিত। মব লিঞ্চিং ও বুলডোজার তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। গেরুয়া বসনধারী এক শ্রেণির যোগী ও সন্ন্যাসিরা এখন প্রকাশ্য মুসলিম বিরোধী গণহত্যার ডাক দিচ্ছে। দাঙ্গায় প্ররোচনা দিচ্ছে। অবলীলায়। নির্দ্বীধায়। জবাবদিহিতার ভয় নেই।

এই মুহূর্তে সাচার রিপোর্টের কথা বলা এক ধরনের ধৃষ্টতা। সংহতি ও সম্প্রীতি শব্দগুলো এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নয়নের কথা বলা এখন চুড়ান্ত অপরাধ। তোষণ! পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা এখন অর্থহীন। মুসলিমদের চাকরি নেই, ব্যবসা নেই, জমি নেই, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নেই – এসব কথা বলবেন না। এদেশে কোনো বৈষম্য নেই! দলিতরা কোনো অভিযোগ করে না! শুধু মুসলিমদের যত অভিযোগ!

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও