রামমন্দির উদ্বোধনের আয়োজন যেন বিজেপির কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে, অভিযোগ জামাআতে ইসলামী হিন্দের

 

দেশের গণতন্ত্র ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে, অনুদার ও সংখ্যাধিক্যের দিকে এগোচ্ছে। এই মর্মে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করল জামাআতে ইসলামী হিন্দ। শনিবার দিল্লিতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি অধ্যাপক সেলিম ইঞ্জিনিয়ার বলেন, সম্প্রতি কেন্দ্র সরকারের বেশকিছু কর্মকাণ্ডে এই নেতিবাচক লক্ষণ স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশন সমাপ্ত হয়েছে ১৪৬জন বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কার করে। তুচ্ছ অভিযোগে লোকসভা থেকে ১০০ জন এবং রাজ্যসভা থেকে ৪৬জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়। গণতন্ত্রের জন্য এটা অশুভ ইংগিত দেয়। বিরোধী-শূন্য সংসদে সরকারের পলিসি ও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন করার থাকে না। সেই সুযোগে কেন্দ্র সরকার তিনটি বিতর্কিত বিল পাস করিয়ে নিয়েছে। এই তিনটি নতুন আইনে সরকার, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্রকে পুষ্ট করতে চাই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। কিন্তু তার পরিবর্তে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করা হচ্ছে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার বন্দোবস্ত পাকা করা হচ্ছে।

এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি বলেছে, বিশেষজ্ঞরা নয়া ফৌজদারী আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন। তাঁদের মতে, নাগরিকদের বাক স্বাধীনতায় লাগাম পরানো হতে পারে। এই আইনের অপপ্রয়োগের দ্বারা জনগণের সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়াসকে বানচাল করা হতে পারে। নির্বাচন কমিশন সমঝোতা করলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা সন্দেহজনক হয়ে উঠতে পারে। কোনও প্রার্থী সরকার বা প্রতিষ্ঠান-বিরোধী অবস্থানের কারণে রাজনৈতিকভাবে কিংবা নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে পারে। পরিণতিতে দেশের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিঘ্নিত হবে। জামাআতের মতে, পুরো বিষয়টাই অস্বচ্ছ। নির্বাচনী বন্ড এবং তার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিল গঠন প্রক্রিয়াও ভুলে ভরা। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থের উৎস ধোঁয়াশাচ্ছন্ন থাকবে।

মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে সমঝোতা করেছে। ফলে নয়া আইনে স্বতন্ত্র সাংবাদিকতাকে কর্মক্ষেত্রে কঠিন চাপের মুখে পড়তে হবে। স্বাধীনতা বলতে তাদের আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। তথ্য ও সংবাদকে সেন্সর করা হবে। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও পপুলিজমের পক্ষে ন্যারেটিভ তৈরি করে সমাজে বিভাজন ও মেরুকরণ তীব্র করা হচ্ছে। যার মূল টার্গেট হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়। এভাবে সমাজ তথা দেশজুড়ে বহুত্ববাদ এবং সহিষ্ণুতার বাতাবরণকে মিশমার করে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে। এক জাতি, এক দেশ, এক ভাষা, এক সংস্কৃতির নাম করে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের চিরাচরিত পরিবেশকে কলুষিত ও বিঘ্নিত করা হচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এসব চলতে থাকলে ভারত কখনোই জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পেতে পারে না। সাম্য, সম্প্রীতি এবং সুবিচার বজায় না থাকলে বিশ্বের দরবারে দেশের ভাবমূর্তি ধরে রাখা সম্ভবপর নয়।

জামাআতে ইসলামীর সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি অধ্যাপক সেলিম ইঞ্জিনিয়ার আরও বলেন, রামমন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠানকে রাজনীতিকরণ করা উচিৎ হচ্ছে না। খোদ কেন্দ্র সরকার এই মন্দির উদ্বোধনকে রাজনৈতিক ইভেন্টে পরিণত করতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাচ্ছে, পুরো বিষয়টাকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে বিজেপি দল। একে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও মেরুকরণের কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র রচিত হচ্ছে। ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে ফায়দা তুলতে রামমন্দির উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে বিজেপি যেভাবে রাজনৈতিক প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে তার তীব্র প্রতিবাদ করেন সেলিম সাহেব। মন্দির উদ্বোধনের মতো পবিত্র অনুষ্ঠানকে ধর্মীয় সুরসুরি দিতে হীন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সুশীল সমাজ, বিদ্বজ্জন, সিভিল সোসাইটি, সমাজবিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ তথা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল থেকে এ ব্যাপারে নানা সময় নিন্দা ও সমালোচনা করা হলেও একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল এসব বিষয়কে পুঁজি করছে এবং প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। তিনি এও বলেন, অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে যেন বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কর্মসূচি। অথচ এ ধরনের ধর্মীয় অনুষঙ্গে রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, আমলা ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দূরে থাকাই শ্রেয়। বিষয়টা কেবলমাত্র ধর্মীয় পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকলে আপত্তি ও বিরোধের কিছু ছিল না।

২২ জানুয়ারি মন্দির উদ্বোধনের দিনটিকে স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে তুলনা করায় রাম জন্মভূমি ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদকের বিতর্কিত মন্তব্যকে ভুল এবং অপরিণামদর্শী বলে অভিহিত করে জামাআত নেতা অধ্যাপক সেলিম ইঞ্জিনিয়ার বলেন, এর মধ্য দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে “আমরা ওরা” বিভাজন তীব্র করার চেষ্টা হচ্ছে। পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সাংসদ তথা মন্ত্রী হওয়ার সময় শপথবাক্য পাঠ করার বিষয়টি তুলে ধরে এদিন তিনি বিজেপি নেতা-মন্ত্রী তথা কেন্দ্র সরকারকে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা পালনের আহ্বান জানান।

সদ্য পাস হওয়া বিতর্কিত টেলিকম বিল প্রসঙ্গে সেলিম সাহেব উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, গোটা দেশের গণতন্ত্রই এখন নজরবন্দি। প্রত্যেক নাগরিকের টেলিফোন কলের ওপরেও নজরদারির পথ প্রশস্ত করা হয়েছে এই বিলে। অর্থাৎ বাক স্বাধীনতা থেকে শুরু করে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকেও খর্ব করা হতে পারে এই নয়া আইনে। এটা গণতন্ত্রের জন্য খুব বড় চ্যালেঞ্জ এবং হুমকি। এভাবে গোটা দেশের ওপর গোপন নজরদারি চালানো বা আড়িপাতায় আইনি ছাড়পত্রকে তিনি বলেন, সরকারের হাতে অবাধ ক্ষমতা তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে টেলিকম বিল-২০২৩ এ। যা আদৌ কাম্য নয়। এভাবে ব্যক্তিগত জীবনের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর আড়ি পেতে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাকে দুর্বিষহ করে তোলার বন্দোবস্তের নিন্দা জানিয়ে আশঙ্কাজনক অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের আশঙ্কার মূল কারণ, বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং অরাজনৈতিক হয়েও যারা বিজেপি-আরএসএস এর কট্টরপন্থী মতাদর্শের বিরোধী, মূলত তাদেরকেই টার্গেট করতে এই টেলিকম আইনের অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ করা হবে। এভাবে আসলে ত্রাসের রাজত্ব বা পুলিশি রাষ্ট্র কায়েমের ছক কষছে কেন্দ্র সরকার। যেখানে গণতন্ত্র, সংবিধান, সংসদ কোনকিছুর তোয়াক্কা করা হবে না। প্রশাসন তথা সরকারের হাতে অবাধ ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে এসব আইনে। এমতাবস্থায় কেন্দ্র সরকারকে সংশ্লিষ্ট বিতর্কিত ও আপত্তিজনক অনুচ্ছেদগুলো প্রত্যাহার করে তারপর নতুন বিলগুলো কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছে জামাআতে ইসলামী হিন্দ। যাতে দেশবাসীর স্বাধীনতা ও অধিকার সর্বৈব সুরক্ষিত থাকে। উল্লেখ্য, এই প্রেস বিবৃতিতে সই করেছেন জামাআতের মিডিয়া বিভাগের জাতীয় সেক্রেটারি কে.কে সুহাইল।

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও