সরাফ আহমেদ
জার্মানির ছোট-বড় সব শহরে গত সপ্তাহ থেকে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করছে। তাদের দাবি, চরম রক্ষণশীল নাৎসিবাদী অলটারনেটিভ ফর জার্মানি দলটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
এএফডি বা অলটারনেটিভ ফর জার্মানি, আর নাৎসি হিটলারের এনএসডিএপি দলটির নাম ও নীতির মধ্যে বেশ সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
হিটলারের পতন ঘটেছে সেই ১৯৪৫ সালে। তবে তাঁর নাৎসিবাদী চিন্তাচেতনার ভূত বারবার ফিরে আসছে জার্মান রাজনীতিতে। ২০১৩ সালে গঠিত অলটারনেটিভ ফর জার্মানি বা জার্মানির জন্য বিকল্প দলটির কার্যক্রম ক্রমেই জার্মানির মূল ধারার রাজনীতিকে বিষাক্ত করে তুলছে।
১০ জানুয়ারি বার্লিনের অনতিদূরে পটসডাম শহরের একটি হোটেলে ডানপন্থী কট্টরবাদীদের একটি গোপন বৈঠকের কথা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই জার্মানিজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। জার্মানির টাজ পত্রিকাটি জানিয়েছে, এই গোপন বৈঠকে ভবিষ্যতে তাদের রাজনীতির নীতিনির্ধারণ, আর্থিক বিষয়সহ বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে অলটারনেটিভ ফর জার্মানির রাজনীতিবিদ ও তাঁদের প্রতি সহনশীল ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা এবং অস্ট্রিয়ার ডানপন্থী আইডেনটিটি মুভমেন্টের সাবেক প্রধান মার্টিন সেলনারসহ বেশ কিছু নাৎসি মূল্যবোধের ধারক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
ষড়যন্ত্রমূলক এ বৈঠকের মূল বিষয় ছিল জার্মানি থেকে লাখ লাখ অভিবাসীকে বিতাড়িত করার উপায় খোঁজা। হিটলারের দলও ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় এসে এই গণনির্বাসনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছিল।
যাঁদের অভিবাসনের ইতিহাস আছে, যাঁর গায়ের রং শ্বেতাঙ্গ নয়, যাঁরা উদ্বাস্তুদের সাহায্য–সহযোগিতা করে, জার্মান সমাজব্যবস্থায় যেসব অভিবাসীরা নিজেদের মিশিয়ে নিতে পারছেন না, তাঁদের জার্মানি থেকে নির্বাসিত করার বিষয়ে হিটলারের অনুসারী এএফডি দল আলোচনা করেছে।
এ ঘটনা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পুরো এএফডি দলটির ভয়ংকর চেহারা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সবাই বুঝতে পারছে, দলটি আবারও জার্মানিতে জাতিগত জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দিতে চায়।
এ ছাড়া জার্মানির বর্তমান জোট সরকারও জার্মান জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। অভিবাসী বিষয়ে মূলধারার দলগুলোর দোদুল্যমান রাজনীতি জার্মানিতে নাৎসিদের নতুন করে উত্থানে সহায়ক হচ্ছে। এখন কট্টরবাদীরা জার্মানির মাটিতে যা ঘটাচ্ছে, তা রুখতে জার্মানির রাজনীতিতে নতুন ভাবনার সময় এসেছে।
তাদের এই অমানবিক ও সংবিধানবিরোধী মনোভাব জার্মানিকে নতুন করে হুমকির মুখে ফেলেছে। জার্মানির গবেষণা পোর্টাল গোপন বৈঠকের তথ্য উন্মোচন করে বলেছে, এএফডির নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদদের এ পরিকল্পনা হিটলারের দলটির মতোই সুস্পষ্ট ও সমান্তরাল।
নেতৃস্থানীয় এএফডি রাজনীতিবিদের এই গোপন বৈঠকে জার্মানি থেকে গণনির্বাসনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যেমনটি করেছিল হিটলারের এনএসডিএপি দলটি।
একই সময়ে একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, এএফডি দলটি আগামী সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় জার্মানির পূর্বাঞ্চলে তিনটি রাজ্য—থুরিংগিয়া, স্যাক্সনি ও ব্র্যান্ডেনবার্গ রাজ্যসভার নির্বাচনে অন্য সব দলের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। রাজ্য তিনটিতে তাদের সরকার গঠন করা বা গঠনে অন্যতম সহায়ক শক্তি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া না।
এ বৈঠকের কথা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই প্রথমে বার্লিন ও পটসডাম শহরে, পরবর্তীকালে জার্মানিজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমেছেন।
‘গণতন্ত্র রক্ষা করুন’ স্লোগান দিয়ে ১৩ জানুয়ারি বার্লিন গেটে বিশাল বিক্ষোভ হয়। একই দিনে পটসডাম শহরে বিক্ষোভ হয়। সেখানে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক অংশ নিয়েছেন। এ মুহূর্তে দেশজুড়ে রক্ষণশীল নাৎসিবাদী দলটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঝড় বইছে।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আমাদের এখনই লড়াই করতে হবে এবং আমাদের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে দলটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে।’
জার্মানিজুড়ে বিক্ষোভকারীরা ও শীর্ষস্থানীয় মূলধারার রাজনীতিবিদেরা ডানপন্থী পপুলিস্ট দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানিকে নিষিদ্ধ করার কথা বলছেন। তবে এ ধরনের দলকে সহসা নিষিদ্ধ করা জার্মান শাসনতান্ত্রিক ধারা অনুযায়ী একটি জটিল বিষয়।
অলটারনেটিভ ফর জার্মানি দলটি জার্মান পার্লামেন্টের নির্বাচনে ২০১৩ সালের নির্বাচনে জার্মান সংসদে কোনো আসন না পেলেও ১৯১৭ সালের নির্বাচনে ৯১টি এবং ২০২১ সালের নির্বাচনে ৭৯ আসন নিয়ে জার্মান সংসদে নিজেদের ভিত্তি রচনা করে নিয়েছে। এ ছাড়া জার্মানির ১৬টি রাজ্যের ১১টি রাজ্য সংসদে তাদের অবস্থান রয়েছে।
জার্মানির সুপরিচিত সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, অলটারনেটিভ ফর জার্মানি দলটির ওপর নিষেধাজ্ঞা একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। কারণ, জার্মান সংবিধান সুরক্ষার জন্য সর্বোচ্চ আদালত দলটিকে ডানপন্থী দল হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করলেও নিষিদ্ধ করার মতো যথেষ্ট আলামত তাদের হাতে নেই। আর আদালতে গিয়ে নিষেধাজ্ঞার পক্ষে রায় না পেলে দলটির জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।
তবে নিষিদ্ধ করার জন্য জার্মানির সব গণতান্ত্রিক দলকে অবশ্যই অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে, যা এখনো হয়নি। জার্মান জাতীয় সংসদ বা বুন্ডেশটাগ, জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ বা বুন্ডেশরাট ও কেন্দ্রীয় সরকারকে নিষেধাজ্ঞার জন্য আবেদন করতে হবে।
এরপর জার্মানির সর্বোচ্চ সাংবিধানিক বা বিচারিক আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন, অলটারনেটিভ ফর জার্মানি দলটি নিষিদ্ধ করা যায় কি না! জার্মানিতে রাজনৈতিক দল নিষেধাজ্ঞা নীতির বিষয়ে বিশ্লেষণ করে সাংবিধানিক আইনজীবীরা বলেছেন, এখন পর্যন্ত এএফডি দলটি নিষিদ্ধ করার মতো যথেষ্ট আক্রমণাত্মক ও ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠেনি।
এত গেল আইন–আদালতের বিষয়। কিন্তু জার্মানির বিষয়টি ভিন্ন। যে দেশে অনটন নেই, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, গৃহায়ণের সমস্যা নেই, সে দেশে ক্রমশই বর্ণবাদীদের উত্থান আর আস্ফালন বিস্ময়কর। ইউরোপের দেশে দেশে বর্ণবাদ বা উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হত্যা হামলা ক্রমশই বাড়ছে, তবে জার্মানির বিষয়টি ভিন্ন। যারা দুটি বিশ্বযুদ্ধ করে পরাস্ত হয়েছে, তাদের সেই অপরাধবোধ বা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার সেই দায়বদ্ধতা কোথায়!
১৯৩৯ সালে জার্মানির কট্টর বর্ণবাদী নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টির নিজস্ব এসএস গোয়েন্দা বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে নির্মম ও ত্রাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। এই বাহিনী অন্য বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা বা ভিন্ন ধারার রাজনীতিকদের নির্মমভাবে অত্যাচার বা হত্যা করতেন।
জার্মানির সাম্প্রতিক নানা ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয়, অর্থনৈতিক সংকট হলেই যে উগ্র লোকরঞ্জনবাদের প্রাদুর্ভাব হবে, তা ঠিক নয়। এ ধারণা এখন বদলে গেছে।
অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ম্ভর দেশগুলোতেও এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। এখনকার জার্মানি বা ইউরোপের জাতীয়তাবাদী নেতারা সাংস্কৃতিক বৈসাদৃশ্য, জাতিসত্তা, অভিবাসী, সন্ত্রাসবাদ ও ইসলাম ধর্মের ধুয়া তুলে জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন।
এ ছাড়া জার্মানির বর্তমান জোট সরকারও জার্মান জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। অভিবাসী বিষয়ে মূলধারার দলগুলোর দোদুল্যমান রাজনীতি জার্মানিতে নাৎসিদের নতুন করে উত্থানে সহায়ক হচ্ছে। এখন কট্টরবাদীরা জার্মানির মাটিতে যা ঘটাচ্ছে, তা রুখতে জার্মানির রাজনীতিতে নতুন ভাবনার সময় এসেছে।
সূত্র: প্রথম আলো