আধার কার্ড বাতিল : নদিয়ায় সরেজমিন অনুসন্ধানে সিপিআই(এমএল) প্রতিনিধি দল

 

সম্প্রতি দেশ এবং রাজ্য জুড়ে বহু মানুষের আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে। ইউআইডিএআই এর রাঁচির রিজিওনাল অফিস থেকে ডাকযোগে চিঠি পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এই খবর জানানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এই ঘটনা ঘটেছে। আধার নিষ্ক্রিয় হবার ফলে ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা লেনদেন করা যাচ্ছে না। মানুষের মধ্যে অর্থ-সমস্যা, অসহায়তা, আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে কিছু যোগাযোগের ভিত্তিতে গত ২০ ফেব্রুয়ারি পার্টির নদীয়া জেলা কমিটির তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের শিবনিবাস অঞ্চলের সুকান্তপল্লী গ্রামে আধার নিষ্ক্রিয়করণ সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসন্ধান চালায়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন পার্টির নদিয়া জেলা কমিটির সদস্য জীবন কবিরাজ, বিপ্লবী যুব এসোসিয়েশনের রনজয় সেনগুপ্ত ও কল্যাণ মুখার্জী।
এই অঞ্চলের প্রায় ৭০০ মানুষের আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় করে দেয় ইউআইডিএআই দপ্তর। যাদের কার্ড বাতিল হয় তারা সবাই মতুয়া তথা নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ, এবং বেশিরভাগই অসংগঠিত শ্রমিক বা ক্ষেতমজুর। আধার কার্ড বাতিল হওয়ার ফলে তাঁদের সমস্ত নাগরিক সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংক থেকে তাঁরা টাকা তুলতে পারেন না, রেশন বন্ধ, এমনকি যে ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়েছিল তাদেরও রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়। গোটা এলাকা জুড়ে এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আগে থেকে যোগাযোগ করা অনেকেই অজানা ভয়ে মুখ খুলতে চায় না, কেউ বা এড়িয়েও যেতে থাকে। প্রতিনিধিরা এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের কথা জানান। তারপর গ্রামের ভেতরে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাঁদের আলোচনা হয়। গ্রামবাসী অখিল সমাদ্দার, অরবিন্দ বিশ্বাস, শম্ভু নাথ পাত্র, বাদল বিশ্বাস, শান্ত বিশ্বাস, আকাশ বিশ্বাস, ইন্দ্রজিৎ মণ্ডল, অরবিন্দ বিশ্বাস, সমীর বিশ্বাস সহ অনেকের সঙ্গে কথা হয়। ওনারা বেশীরভাগ কৃষিশ্রমিক, সবজি বিক্রেতা ছোটখাটো ব্যবসা, কৃষি কাজ, গ্রামীন চিকিৎসক, প্রাইভেট টিউশানের মতো বিভিন্ন পেশায় যুক্ত। এই মানুষগুলো কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, কী এমন হল গ্রামের ৭০০ মানুষের আধার অকেজো হয়ে গেল! কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিস থেকে, গ্রামের স্কুলের শিবির থেকে, সাইবার ক্যাফে থেকে প্রয়োজনীয় কাগজ দিয়েই তাঁরা আধার কার্ড করেছিলেন।
ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে আধার কার্ড বাতিল নিয়ে বিজেপি তাদের ঘৃণ্য রাজনীতি করতে নেমে পড়েছে। সকলেই জানান, বিজেপি গ্রামে গ্রামে মিটিং করে প্রচার চালাচ্ছে, “এটা আসলে মুসলমানদের তাড়ানোর জন্যই করেছে বিজেপি সরকার।” বিজেপির গ্রাম স্তরের নেতারা এটাও বলেছে, “মোদীর উপর ভরসা রাখো তোমাদের কিছু হবে না। আমরা আধার কার্ড বাতিল করতে পারি আবার ঠিক করেও দিতে পারি। আমাদের সাথে থাকো। আমাদের ভোট দাও।”
পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মূলত দলিত, নমঃশূদ্র মতুয়াদের এই কার্ড বাতিল হয়েছে। ২১ তারিখ অবশ্য বিকেলে এদের অনেকের কার্ড আবার সক্রিয় হয়ে যায় বলে জানা গেছে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার বলছে এটা নেহাতই টেকনিক্যাল ফল্ট, কিন্তু বেছে বেছে নমঃশূদ্র মতুয়াদের বাতিল হওয়ার পেছনে বিজেপির একটি গভীর ষড়যন্ত্রের কথা অনেকেই বলছেন। একদা ওপার বাংলা থেকে এপারে আসা দলিত মানুষদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে আদতে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে ভোট কেন্দ্রীভূত করাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য বলে অনেকে মনে করছেন। এমন একটা বার্তা দিতে চাইছে ফ্যাসিস্টরা যে, নাগরিকত্ব তারাই কেড়ে নিতে পারে আবার তারাই দিতে পারে। আর একটা আশঙ্কার বিষয় অনেকে মনে করছেন, আধার-এর মাধ্যমে ইতিমধ্যেই নাগরিক পঞ্জি তৈরি করে ফেলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতীয় জনতা পার্টির তিনজন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য নেতা তিন রকম মন্তব্য করেছেন।কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বলেছেন, টেকনিক্যাল ত্রুটির কারণে আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হয়েছে। রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলছেন, সোমবার মাঝরাতের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর স্পষ্ট বক্তব্য, রাঁচির রিজিওনাল অফিসে টাকা দিয়ে মমতা ব্যানার্জী এই কাজ করিয়েছেন।
ইউআইডিএআই-এর এক কর্তা সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন, তাঁরা কোন আধার বাতিল করেননি। বোঝা গেল না বাতিল না করলেও নিষ্ক্রিয় করেছেন কিনা। কারণ ক্যান্সেলেশন ও ডিঅ্যাক্টিভেশন শব্দ দুটোর অর্থ এক নয়।
ভুক্তভোগীরা নেতাদের বক্তব্য শুনে বিভ্রান্ত, বিরক্ত। তাঁদের সাফ কথা, সবাই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে। সামনে লোকসভা নির্বাচন। সবাই নিজেদের কথা ভাবছে, আমাদের কথা কে ভাবছে? এই প্রতিবেদন লেখার সময় জানা গেল, অনেকের আধার আবার সক্রিয় হয়েছে।
আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হওয়া ও পুনরায় সক্রিয় হওয়ার মধ্যে অনেকে কেন্দ্রীয় শাসকদলের অদৃশ্য হাত কাজ করছে বলে মনে করছেন। জনতার আনুগত্য আদায় করার রাজনৈতিক কৌশল কিনা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। মানুষের আধার-উদ্বেগ কিন্তু আধার সক্রিয় হবার পরও কাটেনি। এই উদ্বেগ কাজে লাগিয়েই কি ভোট বৈতরণী পেরোনোর চেষ্টা হবে?
সিপিআইএমএল-এর নদিয়া জেলা কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিভিন্ন এলাকায় এই ধরনের গ্রামবাসীদের নিয়ে বৈঠক করার কাজ আগামী দিনে চালিয়ে যাওয়া হবে ও একটি প্রচার পত্র প্রকাশ করা হবে।
যে স্লোগানগুলিকে তুলে ধরে প্রচার করা হবে তা হল:

● আধার কার্ড বাতিল করে ঘুরপথে এনআরসি চালু করার চক্রান্ত চলবে না।
● আধার কার্ড বাতিল করে নাগরিকদের হয়রানি ও দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন বিজেপি জবাব দাও।
● নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ এক হও

● আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় করার কাজ করলো কারা? রাজ্য সরকারকে দ্রুত তার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।

প্রতিবেদক: রণজয় সেনগুপ্ত, কল্যান মুখার্জী

(সৌজন্যে: আজকের দেশব্রতী, ২২ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত)

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও