ইলেক্টোরাল বন্ড স্কিমকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্ট এই বন্ড যাদের মাধ্যমে বেচাকেনা হত সেই স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইণ্ডিয়াকে বলেছিল, এই মামলার সময় পর্যন্ত যত বন্ড ইস্যু করা হয়েছে এবং ভাঙানো হয়েছে তার সম্পূর্ণ ও বিস্তারিত তথ্য জমা দিতে হবে। এসবিআইকে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলা হয়েছিল, ৬ মার্চের মধ্যে দাতা, গ্রহীতা ও টাকার অঙ্ক নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিতে হবে এবং নির্বাচন কমিশন তা ১৩ মার্চের মধ্যে জনসমক্ষে প্রকাশ করবে। সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশ জারি হয় ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ, এবং এসবিআই পরিপূর্ণ তিন সপ্তাহ সময় পেয়েছিল এই নির্দেশ বাস্তবায়িত করার। কিন্তু সময়সীমার ঠিক দু’দিন আগে এসবিআই বিস্তারিত তথ্য জমা দেওয়ার জন্য ৩০ জুন পর্যন্ত সময় চেয়েছে।
এসবিআই এই আবেদনের যুক্তি হিসেবে বলেছে, বন্ডের সংখ্যা এতই বিপুল যে এত কম সময়ের মধ্যে সব তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ করা সম্ভব নয়। এসবিআই-এর হিসেব অনুযায়ী ২২,২১৭ টি বন্ড ছাড়া হয় ২০১৯এর এপ্রিল মাস থেকে ২০২৪এর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এবং এতগুলো বন্ড ইস্যু করা ও তা ভাঙানোর সমগ্র তথ্য নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে একত্রিত করা বস্তুগতভাবে অসম্ভব। ব্যাঙ্ক পরিচালনা ও গণনার বিশেষজ্ঞ যারা, যারা এরকম তথ্য প্রক্রিয়াকরণের সাথে বিশেষ পরিচিত, তাঁরা যারপরনাই অবাক, আজকের এই ডিজিটাল ব্যাঙ্কিংএর যুগে ভারতের সবচেয়ে বড় সরকারি ব্যাঙ্ক, অন্য কোনও নোডাল এজেন্সি দ্বারা নয়, সম্পূর্ণত নিজেদের দ্বারা ইস্যু করা ও ভাঙানো বন্ড সম্পর্কে কয়েকটি মূল মূল তথ্য জোগাড় করতে আরো প্রায় চার মাস সময় চেয়ে এরকম হাস্যকর আবেদন জানাতে পারে!
এসবিআইয়ের আবেদনের উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার। ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন পর্ব সমাধা হয়ে যাবে। ফলত বিজেপির বড় বড় দাতাদের নাম আর নির্বাচকমণ্ডলীর জানা হবে না। অন্য কথায় বললে, ইলেক্টোরাল বন্ড স্কিম বিলুপ্ত হয়ে গেলেও মোদি জমানার কর্পোরেট স্যাঙাতদের আড়ালে থাকার যে গ্যারান্টি এই স্কিমে দেওয়া ছিল তা বজায় থাকল, অন্ততপক্ষে এই নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত। ইডি ও সিবিআই-এর মত কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে রাজনৈতিক বিপক্ষকে নিশানা বানানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, আর অন্যদিকে এসবিআই বা সেবি-র মত আর্থিক এজেন্সি ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলির নাকে দড়ি বেঁধে ব্যবহার করা হচ্ছে মোদি সরকার ও বৃহৎ কর্পোরেটের আঁতাত রক্ষা করার কাজে। মোদি গোটা দেশকে তার পরিবার হিসেবে দেখাতে চাইছেন, আর বাস্তবে তিনি তার আসল পরিবারের এইসব কর্পোরেটদের আড়াল করার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন আইন লঙ্ঘন করে আর সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকে খর্ব করে।
সুপ্রিম কোর্টের কাছে এসবিআই-এর আবেদন প্রকৃতপক্ষে বিচারবিভাগের প্রতি প্রশানের চরম অবমাননার প্রকাশ। সাম্প্রতিক অতীতে সরকার দুটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রায়কে তড়িঘড়ি সন্দেহজনক সব আইন পাশ করে উল্টে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি অবমাননার মনোভাব প্রকাশ করেছে। একটি হল, সুপ্রিম কোর্ট যে ক্ষমতাকে যাথার্থ্য দিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল দিল্লির নির্বাচিত রাজ্য সরকারের সেই ক্ষমতাকে কেড়ে নেওয়া, আর অন্যটি হল ইলেকশন কমিশন নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের হাতে চরম ক্ষমতা ন্যস্ত করা। ইলেক্টোরাল বন্ড ইস্যুটি হল সরকার ও সর্বোচ্চ আদালতের সংঘর্ষের এরকম তৃতীয় বৃহৎ ঘটনা যেখানে নাম গোপন রেখে কর্পোরেট চাঁদার এক অসাংবিধানিক স্কিম ছয় বছর চালিয়েও এবং সাড়ে ছয় হাজার কোটির বেশি টাকা বিজেপির তহবিলে ঢুকিয়েও সরকার পার পেয়ে গেল।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কার্যকর করা বিলম্বিত করতে এসবিআই তার আবেদনে টেকনিক্যাল কারণ দেখাচ্ছে। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি কিন্তু ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে শীর্ষ আদালতের ইলেক্টোরাল বন্ড রায়কে বিদ্রুপ করেছেন কৃষ্ণ-সুদামার উপমা টেনে। কৃষ্ণ-সুদামার কিংবদন্তি গল্পে কৃষ্ণের বাল্যবন্ধু সুদামা, এক গরিব ব্রাহ্মণ, বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ কৃষ্ণকে কয়েক মুঠো চাল দিয়েছিলেন, আর প্রতিদানে সুদামার কুঁড়েঘরকে প্রাসাদ করে দিয়েছিলেন কৃষ্ণ। মোদি আমাদের বোঝাতে চান যে কর্পোরেটদের দেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা আসলে বন্ধুকে দেওয়া সুদামার কয়েক মুঠো চালের সমতুল্য এবং মোদির সরকার আদানি ও আম্বানিদের ওপর যে সুযোগসুবিধা বর্ষণ করছে তা নিছক বন্ধুত্বের খাতিরে, সেখানে কোনো দেওয়া নেওয়ার হিসেব নেই। একদিকে জনগণকে বিভাজিত করতে সংঘ-বিজেপির ঘৃণা অভিযানে আর অন্যদিকে কর্পোরেট তোষণে– মহাকাব্যের কিংবদন্তি নায়ক রাম ও কৃষ্ণের নামের এমন নির্লজ্জ ব্যবহারের উদাহরণ আর কীই বা হতে পারে!
মোদি সরকার ও ভারতের শীর্ষ কর্পোরেট গোষ্ঠিগুলির এই নিবিড় আঁতাত গুটিকয় ব্যক্তির হাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার এক অভূতপূর্ব কেন্দ্রীভবন ঘটিয়েছে। মোদি সরকার দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষমতার একচেটিয়াকরণ যেমন ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারসাম্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভিত্তিক নির্বাচনী গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ বেসামাল করে তুলেছে, তেমনই আদানি ও আম্বানির মত গুটিকয় সর্বময় ক্ষমতাশালী গোষ্ঠির নিয়ন্ত্রণে সমগ্র অর্থনীতি চলে যাওয়াটা ভারতের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক, কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী ও চাকরিপ্রার্থী তরুণ প্রজন্মকে এক নিরন্তর দুর্দশায় নিক্ষেপ করেছে। আসন্ন নির্বাচনে মোদি সরকারকে পরাজিত করাটা তাই এই ফ্যাসিস্ট কর্পোরেট নাগপাশ থেকে ভারতীয় জনগণকে ও ভারতের সংবিধানকে মুক্ত করার প্রথম ধাপ।
-এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৫ – ১১ মার্চ ২০২৪ (ভাষান্তর: দেশব্রতী পত্রিকা)