মমতা ব্যানার্জীর প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কি মোহভঙ্গ হয়েছে? কী বলছে বিবিসির রিপোর্ট

 

সাগরদিঘী উপনির্বাচনের পর বিবিসি বাংলা একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, “পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম-অধ্যুষিত একটি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের পরাজয়ের পর প্রশ্ন উঠছে যে সেখানকার মুসলমানদের একাংশ কি মমতা ব্যানার্জীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন?

মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘীতে সম্প্রতি একটা উপনির্বাচন হয়েছে, যেখানে রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৩৫% ভোট, আর জয়ী হয়েছে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোটের প্রার্থী, যিনি পেয়েছেন ৪৭ শতাংশেরও বেশি ভোট।

ওই আসনটি মুসলমান অধ্যুষিত। সেখানকার প্রায় ৬৫% ভোটারই মুসলমান। আসনটি এর আগে তৃণমূল কংগ্রেসেরই দখলে ছিল।

ভোটের ফল নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী নিজেও। হারের কারণ খুঁজে বার করতে মুসলমান সম্প্রদায়ের পাঁচজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি।

‘কিছুটা মোহভঙ্গ হয়েছে’
রাজ্যের মুসলমানরা যে মমতা ব্যানার্জী এবং তৃণমূল কংগ্রেসকে একচেটিয়া ভোট দিয়ে এসেছেন, সেটা ২০১১ থেকে ২০২১ – বারে বারেই প্রমাণিত হয়েছে।

বিশেষত ২০২১ সালের ভোটে কংগ্রেস আর বামপন্থীরা যে কোনও আসন পান নি, তার একটা বড় কারণ প্রায় সব মুসলমানই তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন। ওই নির্বাচনে মুসলমানদের সামনে একটা আতঙ্ক ছিল যদি বিজেপি জিতে যায়, তাহলে তাদের সমূহ বিপদ। তাই বিজেপিকে হারাতে সবশক্তি দিয়ে তারা মমতা ব্যানার্জীকে সমর্থন করেছিলেন।

কিন্তু দু’বছরেরও কম সময়ে কী এমন ঘটল যে মুসলমান-প্রধান একটা অঞ্চলে তৃণমূল কংগ্রেস হেরে গেল?

বিশ্লেষকরা বলছেন সাগরদিঘীতে তৃণমূল কংগ্রেস হারার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে বড় কারণ হচ্ছে- মুসলমান সমাজের একটা অংশের কিছুটা ‘মোহভঙ্গ’ হয়েছে মমতা ব্যানার্জীর প্রতি।

নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রতিষ্ঠিত প্রতীচী ট্রাস্টের গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক সাবির আহমেদের কথায়, “সংখ্যালঘুরা মমতা ব্যানার্জীকে তো ভোট দিয়েছিল অনেক আশা নিয়ে, যার মধ্যে চাকরি-বাকরির আশা যেমন ছিল, তেমনই রাজনীতিতে তাদের অংশীদারিত্ব বাড়বে সেটাও তারা আশা করেছিল। এবারে তো মুসলমান বিধায়কের সংখ্যা কমে গেছে কারণ তারা কম সংখ্যায় মুসলমান প্রার্থী দিয়েছিল। মমতা ব্যানার্জী যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলো সব যে পূরণ হয়েছে তা তো নয়।”

“আবার আরএসএস-বিজেপির মোকাবিলা করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে সফট কমিউনালিজমের পথ নিয়েছেন, গঙ্গা আরতি শুরু হচ্ছে, দীঘায় জগন্নাথ মন্দির তৈরি হচ্ছে, তার নিজের নানা হিন্দু আচার অনুষ্ঠানে-মন্দিরে যাওয়া – এসব কারণে একটা অংশের কিছুটা তো মোহভঙ্গ হয়েছেই,” বলছিলেন সাবির আহমেদ।

মমতা ব্যানার্জীর ‘নরম হিন্দুত্ব’?
সাগরদিঘী কেন্দ্রে উপনির্বাচন এমন একটা সময়ে হয়েছে, যখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে আছে দুর্নীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের জড়িয়ে পড়ার অভিযোগের কারণে।

মাঝে মাঝেই কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হচ্ছে কারও বাড়ি, ফ্ল্যাট বা অফিস থেকে। ওই সব বেআইনি অর্থ উদ্ধারের ঘটনায় জড়িয়ে যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের বড়-ছোট নেতাদের নাম।

তবে কথিত দুর্নীতির মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে শিক্ষক নিয়োগে বিরাট দুর্নীতির ঘটনা।

শিক্ষক-নিয়োগ পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা দেওয়া থেকে শুরু করে কম নম্বর পাওয়া শত শত চাকরিপ্রার্থীদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অর্থের বিনিময়ে। বেআইনি ভাবে নিযুক্ত এরকম শিক্ষকদের হাইকোর্ট বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে আর ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব ও প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জীসহ একাধিক নেতা।

“স্কুলশিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, গ্রামস্তরে আবাস যোজনায় দুর্নীতি – এসব তো প্রকাশ পাচ্ছে গণমাধ্যমে। সারা রাজ্যের মানুষ তো দেখছেন, সাগরদিঘীর মানুষও দেখেছেন। আবার মুসলমানরা এটাও দেখছেন যে মমতা ব্যানার্জী কিছুটা নরম হিন্দুত্বের পথ ধরেছেন। মুসলমানদের আশাহত হওয়ার ইস্যু তো ছিলই, তার সঙ্গে রাজ্যের যে সার্বিক ইস্যু, সেগুলোও যোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে,” বলছিলেন ওয়েলফেয়ার পার্টির রাজ্য মিডিয়া সম্পাদক মোকতার হোসেন মণ্ডল।

‘মুসলমানদের আস্থার অভাব হয় নি’
কয়েক মাসের মধ্যেই রাজ্য গ্রাম ও জেলা স্তরে পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে। পঞ্চায়েতগুলির মাধ্যমেই যেহেতু সব সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হয়, তাই রাজনৈতিকভাবেও এই ভোটের গুরুত্ব আছে। তাই সাগরদিঘীর ফল নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে তৃণমূল কংগ্রেস।

এরকম একটা মুসলমান-অধ্যুষিত আসনে কেন দলকে হারতে হল, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই।

গত সোমবার রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠকে তিনি বিষয়টি উত্থাপন করেন, এবং পাঁচজন মন্ত্রীর একটি কমিটি গঠন করে দেন সাগরদিঘীতে হারার কারণ খুঁজে বার করতে।

ওই কমিটি বৃহস্পতিবার প্রথম বৈঠক করে। কমিটির অন্যতম সদস্য, রাজ্যের মন্ত্রী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা প্রাথমিক আলোচনা করে যা পেলাম তার সারমর্ম হচ্ছে মমতা ব্যানার্জীর প্রতি মুসলমানদের আস্থার কোনও অভাব ঘটে নি। কিন্তু স্থানীয় স্তরে যাদের ওপরে ভোট করানোর দায়িত্ব ছিল, তারা সেটা ঠিক মতো পালন করেন নি।”

“আর তৃতীয় যে কারণটা উঠে এসেছে তা হলো যেসব উন্নয়নমূলক সরকারি প্রকল্প রয়েছে সেগুলো ঠিক মতো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে নি, যার ফলে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে,” বলছিলেন মি. চৌধুরী।

তারা শুক্রবার আবারও বৈঠক করবেন এবং তারপরে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রিপোর্টও জমা দেবেন।

মি. চৌধুরী জানান, তাদের কমিটি সাগরদিঘী গিয়ে সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন।

অন্যদিকে সাগরদিঘীতে জিতে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোট বেশ উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। অন্তত সামাজিক মাধ্যমে তাদের সমর্থকদের পোস্টগুলি লক্ষ্য করলে সেরকমই মনে হচ্ছে।

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কোনও আসন পায় নি বাম-কংগ্রেস জোট, কিন্তু সাগরদিঘী কেন্দ্রে কংগ্রেসপ্রার্থী বায়রন বিশ্বাসের জয়ের ফলে তারা এখন একটি আসন লাভ করল। বিবিসি বাংলা

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও