রমজানের পর কেমন হবে মুমিনের জীবন

চলে গেল কল্যাণ ও বরকতের মাস রমজান। আমাদের ওপর মাসটি ছিল মেঘের সুশীতল ছায়ার মতো। এ মাসের রোজা ছিল তাকওয়া অনুশীলনের অন্যতম মাধ্যম। মসজিদের মেহরাব ছিল হাফেজদের সুমধুর তেলাওয়াতের ধ্বনিকে সরব। তা ছাড়া কোরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ, জিকির ও দোয়ায় নিমগ্ন থেকে সময় কেটেছে সবার। এ মাসের মতো অন্যান্য মাসেও এসব আমলের ধারাবিহকতা রক্ষা করা সবার কর্তব্য।

রমজান মাস থেকে শিক্ষা

তাকওয়া অর্জন : রোজার প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহভীতি অর্জন করা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘হে ইমানদাররা, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের আগের লোকদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)

তাই রমজান পরবর্তী জীবনে আল্লাহর ভয় অন্তরে ধারণ করে চলতে পারলে দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা সার্থক হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। আর আল্লাহ ভীতি অন্তরে ধারণ করাই মুমিনের মূল সফলতা। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পথ প্রশস্ত করে দেন এবং তাকে ধারণাতীত উৎস থেকে জীবিকা দান করেন।’ (সুরা তালাক, আয়াত : ২-৩)

ধৈর্য ও সংযম : রমজান মাসে রোজার মাধ্যমে মুমিন বান্দারা সবরের অনুশীলন করেছে। এই সময়ে রোজা পরিপন্থি কাজ পরিহার করে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। পাশাপাশি প্রচণ্ড গরমে ক্ষুধা ও পিপাসায় ধৈর্যধারণ করেছে। সারা দিনের ক্লান্তির পর ধৈর্যের সঙ্গে দীর্ঘ তারাবির নামাজ আদায় করেছে। রমজানের ধৈর্যের শিক্ষা শুধু এই মাসের জন্য নয়; বরং জীবনব্যাপী তা অনুসরণীয়। তাই রমজানের ধৈর্য ও সংযমের অভ্যাস জীবনব্যাপী গড়ার চেষ্টা করতে হবে।

শাওয়ালের ছয় রোজা : রমজানের পরের মাস শাওয়াল। এই মাসে ছয়টি রোজার কথা হাদিসে এসেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোজা রাখল, অতঃপর শাওয়াল মাসে ছয় রোজা রাখল, সে যেন সারা বছর রোজা রাখল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৬৪)

এ রোজা ঈদুল ফিতরের দিন ছাড়া শাওয়াল মাসের যেকোনো ছয় দিন রাখা যায়। একসঙ্গেও রাখা যায় আবার পৃথক পৃথকভাবেও রাখা যায়। তবে ঈদের পরপর রাখাই উত্তম। হাদিসের কোনো কোনো ভাষ্য থেকে এমনটিই বুঝে আসে।

ইমাম নববি (রহ.) বলেছেন, উত্তম হলো, ঈদুল ফিতরের পর ধারাবাহিক ছয় দিন রোজা রাখা। কেউ পৃথক পৃথকভাবে রাখলে বা বিলম্ব করে মাসের শেষ দিকে রাখলেও ফজিলত রয়েছে। কারণ সব অবস্থায়ই বলা হবে যে রমজানের পর শাওয়ালের ছয় রোজা রেখেছে। (শরহে মুসলিম : ৪/১৮৬)

রমজানের প্রধান আমল ছিল রোজা। রমজানের রোজা রাখা ফরজ। রমজান ছাড়া অন্য মাসে রোজা রাখা ফরজ নয়। তবে নফল রোজার বিধান পুরো বছরই রয়েছে। অতএব রমজান চলে গেলেও পুরো বছর নফল রোজার আমল অব্যাহত রাখা চাই। বিশেষত ক) জিলহজ মাসের ৯ তারিখ, খ) ৯ বা ১১ তারিখসহ আশুরার দিন, গ) প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার, ঘ) প্রত্যেক চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ বা আইয়ামে বিজের দিন, ঙ) শাবান মাসসহ বিভিন্ন সময়ে রোজা রাখার কথা হাদিসে এসেছে।

কোরআনের সঙ্গে অটুট বন্ধন : রমজান মাসের সঙ্গে কোরআনের সম্পর্ক খুবই গভীর। এই জন্য রমজানে কোরআন নাজিল হয়েছে। নবীজি (সা.) রমজান মাসে কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি খুব যত্নবান থাকতেন। এই মাসে কোরআনের সঙ্গে আমাদেরও নানাভাবে সম্পর্ক ছিল। কোরআন তিলাওয়াত, তারাবির নামাজে অংশগ্রহণ, হাফেজদের তিলাওয়াত শ্রবণ, কোরআন শিক্ষার মজলিসে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন উপায়ে কোরআনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এই সম্পর্ককে বছরের অন্যান্য মাসেও অটুট রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি, তারা তা যথাযথভাবে তিলাওয়াত করে, তারা এর প্রতি বিশ্বাস রাখে; আর যারা তা অস্বীকার করে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১২১)

তাহাজ্জুদ ও নফল নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া : রমজানে সাহরির সময়ে ওঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা অনেকের জন্য সহজ ছিল। এই অভ্যাস পরবর্তী সময়েও অব্যাহত রাখা উচিত। যেন পুরো বছর তাহাজ্জুদের আমল করা যায়। তা ছাড়া ইশরাক, চাশত, সুন্নাতে মুয়াক্কাদাসহ বিভিন্ন নামাজের প্রতি যত্নশীল হওয়া দরকার। আল্লাহ বলেন, ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়ুন, তা আপনার জন্য অতিরিক্ত দায়িত্ব, আশা করা যায়, আপনার রব আপনাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৭৯)

দান-সদকা করা : রমজানে অন্যান্য ইবাদতের পাশাপাশি দান-সদকার প্রতি মুসলমানরা বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে। সবাই নিজ নিজ সাধ্যমতো দান করে। অনেকে এই মাসে জাকাত আদায় করে থাকে। ঈদুল ফিতরে সদকায়ে ফিতর আদায় করে। এই সময়ে অনেকে বিভিন্ন দ্বিনি কাজে আর্থিকভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। কিন্তু গরিব-দুঃখীর প্রতি সহমর্মিতা দেখানো, সম্পদের হক আদায় করা ও দ্বিনের সাহায্য করা শুধু রমজানের আমল নয়। বরং তা পুরো বছর ও জীবনের আমল। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রতিদিন সকালে দুইজন ফেরেশতা আসমান থেকে নেমে আসেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ, দানকারীকে প্রতিদান দিন। (অর্থাৎ আরও সম্পদ দিন। অপরজন বলে, হে আল্লাহ, যে (দান না করে) সম্পদ আটকে রাখে তার সম্পদ ধ্বংস করে দিন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ১৪৪২)

আল্লাহর কাছে দোয়া করা : দোয়া রমজানের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিগুলোর অন্যতম। মানুষ সব সময় আল্লাহর দরবারে দোয়া করছে, আকুতি-মিনতি করছে- এমন দৃশ্য রমজান মাসে সবার মধ্যে দেখা যেত। বিশেষ করে শেষ রাতে তাহাজ্জুদের পর, ফরজ নামাজের পর ও ইফতারের আগ মুহূর্তে দোয়া সবাই দোয়ায় অংশ নেয়। তবে দোয়া কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বরং জীবনব্যাপী তা পালন করা চাই। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের রব বলেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৬০

আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন। (সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ)

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও