মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবিত প্রার্থী একদা বিজেপি মন্ত্রী যশবন্ত সিনহাকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বামপন্থী দলগুলো, একটি আলোচনা

আবার বছর দশেক পরে…

আজ ২২শে জুন। ২০১২-য় এই দিনেই কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থী, মনমোহন সিংহ সরকারের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সমর্থন জানানোর প্রতিবাদে সিপিআইএম দল থেকে পদত্যাগ করেছিলাম। কংগ্রেসের অর্থনৈতিক নীতির ঘোষিত বিরোধি হয়েও সিপিআইএম কেন মনমোহন সিংহ সরকারের অর্থমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন করলো, সেটাই ছিল পদত্যাগের প্রধান কারণ।

পার্টি নেতৃত্ব তখন যুক্তি দিয়েছিলেনঃ ১। প্রণব মুখার্জিকে সমর্থন করলে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস আর কংগ্রেসের মধ্যে বিভাজন ঘটানো যাবে; ২। ভবিষ্যতে যদি কংগ্রেসকে হারিয়ে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে তাহলে প্রণব মুখার্জি ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করবেন।

বাস্তবে কি ঘটেছিল? তৃণমূল কংগ্রেসও রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখার্জিকে সমর্থন করে দেওয়ায় সেযাত্রায় আর কোন বিভাজন ঘটানো যায়নি। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সাথে জোট করে সিপিআইএম দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি পদে থেকে প্রণব মুখার্জি ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় কি ভূমিকা নিয়েছিলেন জানা নেই, তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নাগপুরে আরএসএস সদর দপ্তরে গিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠাতা বলিরাম হেডগেওয়ারকে ভারতমাতার মহান সন্তান বলে সার্টিফিকেট দেন।

……………

দশ বছর পরের আরেকটা ২২শে জুন। আবার দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এসেছে। সিপিআইএম দল একদিকে কংগ্রেস, এনসিপি, সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি অন্যদিকে সিপিআই এবং সিপিআই-এমএল লিবারেশনের মতন কিছু বামদলের সাথে মিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবিত প্রার্থী যশবন্ত সিনহাকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যশবন্ত সিনহা বিজেপি থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে দলবদল করে আসা রাজনীতিক, বাজপেয়ী সরকারের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী।

সিপিআইএম-নেতৃত্বের একাংশের বর্ণনা অনুযায়ী “বিজেমূল” বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে যশবন্ত সিনহা সেটাই – যেমন ছিল বাবুল সুপ্রিয় বা শত্রুঘ্ন সিনহা। রাষ্ট্রপতি পদে ওকে বামপন্থীরা সমর্থন করলেও কোন লাভ নেই, ওর জেতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবিত প্রাক্তন বিজেপি প্রার্থীকে সমর্থন দিলে পশ্চিমবঙ্গে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বৈরাচারী, জনবিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের লড়াইটাই দুর্বল হবে। আখেরে বিজেপি-র লাভ হবে।

যারা বিজেপি-র বিরুদ্ধে সব-বিরোধীদের যেনতেন প্রকারেণ এক হওয়ার যুক্তি দিচ্ছে তারা আসলে হতাশাগ্রস্ত এবং রাজনৈতিকভাবে দিশাহীন। দেশের গোটা বিরোধীপক্ষ মিলে যদি বিজেপি-র বিরুদ্ধে একজন প্রাক্তন বিজেপি নেতা ব্যতীত আর কোন প্রার্থী না খুঁজে পায়, সেই বিরোধী ঐক্য মূল্যহীন। এই ঐক্যের কোন কর্মসূচিগত ভিত্তি নেই, এটা মতাদর্শগত ভাবে দেউলিয়া। এইরকম বিরোধীপক্ষ থাকলে আরএসএস-বিজেপি নিশ্চিন্ত হয়ে আরও বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে রাজত্ব করবে। মহারাষ্ট্রের ঘটনা প্রবাহ সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সিপিআইএম-সহ বামপন্থী দলগুলির উচিৎ দেউলিয়া বিরোধী রাজনীতির এই গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে বিকল্প অবস্থান নিয়ে ভাবা। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গলকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করার সময়কার সংসদীয় শক্তি বামপন্থীদের আজ আর নেই ঠিকই, রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনেক বেশি প্রতিকূল। কিন্তু তাই বলে বামপন্থীদের অবস্থানে কোন বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ থাকবে না? দেশের এই সঙ্কটকালে বামপন্থী দলগুলির এই ভূমিকা কি তাদের সদস্য-সমর্থকদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে? মনে হয় না।

কি করণীয়? আমার মনে হয় সিপিআইএম-সহ সমস্ত বামদলের ভোটদানে বিরত থাকা উচিৎ – abstention। ২০১২-র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও ভোটদানে বিরত থাকার অবস্থানটাই ঠিক ছিল।

যদি কেরালা, তামিলনাড়ু বা বিহারের বাম বিধায়ক-সাংসদরা এতে রাজি না হয় অন্তত পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র বাম সাংসদের অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবিত প্রার্থীকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিৎ।

লেখক: প্রসেনজিৎ বসু (অর্থনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নেতা)

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও