শীতলকুচির তরুণী আফ্রুজা নেট পরীক্ষায় বাংলাতে প্রথম

আহমদ হাসান ইমরান

বাংলার প্রত্যন্ত জেলা কোচবিহারের মাথাভাঙা এলাকার এক ছাত্রী আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ডিগ্রি পাশ করার পর সর্বভারতীয় নেট পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। পশ্চিমবাংলা ছাড়াও ভারতে এখন বিভিন্ন প্রদেশেও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় সাবজেক্ট রয়েছে। যেমন গুয়াহাটি, শিলচর, আগরতলা, দিল্লি, ঝাড়খণ্ড, মুম্বই প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ রয়েছে। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নেট পরীক্ষার্থীদের টক্কর দিয়ে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা আফ্রুজা বাংলা বিষয়ে প্রথম হয়েছে। তাকে আমি টেলিফোনে মোবারকবাদ জানিয়েছি। তার সম্পর্কে পুবের কলম-এ আমি যে প্রতিবেদনটি লিখেছি, তা এখানে শেয়ার করছি।

সকালবেলাতেই ভালো খবরটি পেয়েছিলাম। পুবের কলম-এর সাংবাদিক শামিমা এহসানা হোয়াটসঅ্যাপে জানান, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ডিগ্রি পাশ করা আফ্রুজা খাতুন ইউজিসি-র নেট পরীক্ষায় বাংলা বিভাগে ভারতের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। তারপরই ফোন এল অধ্যাপক সাইফুল্লা সাহেবের। তিনি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। বললেন, আলিয়া থেকে পাশ করা আফ্রুজা খাতুন সর্বভারতীয় নেট পরীক্ষায় বাংলায় প্রথম হয়েছে। জানলাম এই তরুণীর বাড়ি কোচবিহারে। আর এখন সে কোচবিহারেই রয়েছে।
অধ্যাপক সাইফুল্লা পুবের কলমকে বললেন, আমরা আফ্রুজার এই সাফল্যে গর্বিত। আমি ও আমার সহকর্মীরা তাকে ব্যক্তিগত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাকে ফোন করেও আমরা মোবারকবাদ জ্ঞাপন করেছি।
আফ্রুজার এই কৃতিত্ব অবশ্যই সকলকে অনুপ্রাণিত করবে। অন্ধকার সময়েও একটি প্রজ্জ্বল মুখ আমরা দেখছি। তিনি আরও বলেন, ‘আফ্রুজা যখন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, তখন সে ভালো ছাত্রী ছিল। কিন্তু সে যে এত প্রতিভাময়ী তা বুঝতে পারিনি। কোচবিহারে ফিরে যাওয়ার পর আফ্রুজা নিজে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে, পরিশ্রম করেছে। তাই সে নেট পরীক্ষায় এই ফলাফল করেছে।’
একটি টেলিফোন সাক্ষাৎকারে কোচবিহারের মাথাভাঙা থেকে আফ্রুজা খানিকটা আবেগময় কণ্ঠে আমাদের সঙ্গে কথা বলল। আর আমরাও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে আগ্রহী ছিলাম এই জন্য যে, সে অসম সীমান্তবর্তী দারিদ্র পীড়িত জেলা কোচবিহারের মেয়ে। আমার নিজেরও জন্ম, বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গে চা বাগানে, মালনদী ও ডায়নাতে। উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি ও সমস্যার কথা আমি জানি। সম্প্রতি কিন্তু কোচবিহারের পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘুরা শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। এখানে ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু মিশন স্কুল তৈরি হয়েছে। আর এখানকার সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীরা খুব ভালো রেজাল্ট করছে এবং উচ্চতর পড়াশোনার জন্য চলে যাচ্ছে রাজস্থানের কোটা, আলিগড়, দিল্লি বা অন্যস্থানে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুই কিশোরী (মুশফিকা পারভিন, রুমানা খাতুন) এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কোচবিহারের মাথাভাঙার দু’টি স্কুল থেকে দারুণ ফলাফল করেছে। তারা রাজ্যের মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছিল। মাধ্যমিকেও একটি ছাত্র ও দুটি ছাত্রী (আরমান ইসতিয়াক, নাফিসা হোসেন ও রিফা তামান্না) মাথাভাঙা থেকে মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছিল। ঘটনাক্রমে আফ্রুজা খাতুনও মাথাভাঙা থেকেই নেট পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। শুধু কোচবিহার নয়, বাংলার নাম উজ্জ্বল করেছে।
টেলিফোন সাক্ষাৎকারে উচ্ছ্বসিত আফ্রুজা জানাল, তার বাড়ি মাথাভাঙা সাবডিভিশনের শীতলকুচির বরোগদাই খড়া গ্রামে। এই সেই শীতলকুচি, যেখানে বিধানসভা নির্বাচনের সময় ভোটের লাইনে দাঁড়ানো কয়েকজন মুসলিম নাগরিককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে কেন্দ্রীয় বাহিনী। আফ্রুজার আব্বা হাকিম মিয়া কৃষিকাজ করেন। আম্মা হচ্ছেন নুরবানু বিবি, গৃহবধূ। আফ্রুজার উচ্চাকাঙ্খা ছিল, তাই সে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আবদুর রহিম গাজী সাহেবের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সে হস্টেল পায়নি, তাই থাকত বারুইপুরের একটি মহিলা মেসে।
আফ্রুজা তার আব্বা-আম্মার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বলল, আব্বা-আম্মার সমর্থন না থাকলে আমি কখনই মাথাভাঙা কিংবা কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করতে পারতাম না। আমি মুসলিম ঘরের মেয়ে। কিন্তু আমাদের সমাজে মেয়েদের ঘরের বাইরে দূরবর্তী স্থানে পড়াশোন করতে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় না। কিন্তু আমার আব্বা-আম্মা আমাকে কলকাতায় গিয়েও পড়াশোনা করার সুযোগ দিয়েছেন। আফ্রুজা বলেন, আমি ভালো রেজাল্ট করে আমার আব্বা-আম্মার আস্থার মর্যাদা রাখতে পেরেছি। আমার কথা শুনে সমাজের অনেকে অনুপ্রাণিত হবে।
আফ্রুজা পড়াশোনা করেছে শীতলকুচি কলেজে। কোচবিহারের শীতলকুচির এই তরুণী এখন অনেককেই প্রেরণা জোগাবে।

(লেখক পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক। এই লেখাটি তার ফেসবুক থেকে নেওয়া)

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও