কাকে দিয়েছ রাজার পাট?

মুদাসসির নিয়াজ

টানা ২৭ বছর ধরে গুজরাট শাসন করছে বিজেপি। তার মধ্যে গত ৮ বছর চলছে ডাবল ইঞ্জিন সরকার। কিন্তু সেই সরকার খেয়ালই করেনি যে, ডাবল ইঞ্জিনের গাড়ি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য পেট্রোল, ডিজেল ঠিকঠাক ভরা হচ্ছে না, সময়মতো সার্ভিস করা হয় না বা ইঞ্জিন অয়েল বদলানো হয় না। তাই সাইলেন্সার দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, যা থেকে প্রচুর দূষণ (রাজনৈতিক ও সামাজিক) ছড়াচ্ছে, যা গাড়ি বিকল হওয়ার পূর্বলক্ষ্মণ বৈকি। আসলে ডাবল ইঞ্জিন সরকার মানে হল, কেউ ভুল ধরার নেই, কেউ সমালোচনা করার নেই, কেউ প্রশ্ন করার নেই। কেউ বলবে না রাজা তোর কাপড় কোথায়? সকলি তোমারই ইচ্ছা। একতরফা চলিবে সবকিছু। মঙ্গলগ্রহের মতো এখানেও থাকবে না ইডি, সিবিআই এর লুকোচুরি খেলা। এখানে সব রং মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। চোখ মেললেই দেখা যাবে পতপত করে উড়ছে উন্নয়নের গৈরিক ধ্বজা। অধুনা রাজনৈতিক ঘরানায় যাকে বলা যায় এক দেশ, এক সরকার। এই নদীতে কখনও ভাটা আসবে না, ২৪X৭ বইবে কেবলই উন্নয়নের জোয়ার।

সংঘ পরিবারের জন্য হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরি বলে খ্যাত ভূভারতে উন্নয়নের রোলমডেল হল গুজরাত। অতি সম্প্রতি সেই রাজ্যের মাচ্চু নদীর ওপর ঝুলন্ত মোরবি সেতু ভেঙে অকালমৃত্যু হয়েছে প্রায় দেড়শো জনের। এতবড় মর্মন্তুদ কাহিনির পরেও সহমর্মিতা জানাতে যাননি তিনি। কারণ চাণক্য মহারাজ বুঝেছেন, সেতু সংস্কারের মতো জোড়াতাপ্পি দিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে গেলে গুজরাত নির্বাচন হবে গেরুয়া শিবিরের ‘ওয়াটার লু’। তাই ফিল্ডে অবতীর্ণ হয়েছেন টিমের কোচ কাম ক্যাপ্টেন কাম আম্পায়ার (থ্রি ইন ওয়ান)। তাও দুর্ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পর। তার আগে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন ভোট জোগাড়ের ‘দায়বদ্ধতা’। তাই শোকার্ত অসহায় পরিবার নয়, তাঁর শিডিউলে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে কথিত বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের মঞ্চ। উদ্ভাসিত হয়েছেন প্রচারের আলোয়। বিনাশকালে বুদ্ধিনাশের প্রশ্নটা এখন তোলা থাক। এখন যেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, তা হল তাঁদের কাজ কম, ভাষণ আর আসন বেশি। ভাষণেই জোগাড় হয় শাসনের কড়ি। আর তা করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে এমন সব আলটপকা মন্তব্য করে বসেন, যার জন্য মাঝেমধ্যে নিজেরাই বিড়ম্বনায় পড়েন। তখন একঝাঁক ধোপদূরস্ত নেতাকে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামাতে হয়।

২০১৬ সালে বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই ভেঙে পড়েছিল কলকাতার পোস্তার নবনির্মিত ফ্লাইওভার। সেই সময় নির্বাচনী প্রচারে ‘সুনার বংগালে’ ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি পোস্তা সেতু ভেঙে পড়াকে নিছক ‘দুর্ঘটনা’ বলে মানতে চাননি। বানাতে চেয়েছিলেন রাজনীতির মোক্ষম ইস্যু। তাই তিনি দুর্ঘটনাটিকে ‘ঈশ্বরের বার্তা’ বলে চালাতে চেয়ে বলেছিলেন, বোঝাই যাচ্ছে বাংগালে কেমন সরকার চলছে! আজ ব্রিজ ভেঙেছে, কাল গোটা বাংলা ভেঙে পড়বে। এটাই নাকি ঈশ্বরের বার্তা।

যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। তবুও রাজনীতির কারবারিদের অদৃশ্য ছোঁয়ায় তা হয়ে যায় ভোটের উপাদান বা উপাখ্যান। চোখা চোখা ডায়ালগ আর নাটকীয় উপস্থাপনার জোরে সেদিন দলের কর্মী-সমর্থকদের অফুরন্ত হাততালি কুড়িয়েছিলেন আদরণীয় মোদিজী। কিন্তু ভোট-রাজনীতির দক্ষ খিলাড়ী হলেও সেবার বাংলার নির্বাচনী দেওয়াল লিখন তিনি পড়তে পারেননি। তখন তিনি কল্পনাও করতে পারেননি, বিরোধীদের দিকে তাক করে ছোড়া তির একদিন তাকেই বিঁধবে এবং ফালা ফালা করে দেবে তাঁরই ৫৬ ইঞ্চি ছাতিওয়ালা বুক।

তাই ৬ বছর আগে পোস্তা নিয়ে ইট ছুড়ে এখন মোরবিকাণ্ডে পাটকেল খেতে হচ্ছে। উল্লেখ্য, তিনি মোরবি দুর্ঘটনার সময় গুজরাতেই ছিলেন। তা সত্ত্বেও তৎক্ষণাৎ স্বজনহারাদের কান্না তাঁর কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি বা তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের পাশে দাঁড়ানো বা শোক, সমবেদনা কিংবা সান্ত্বনা জানানোর প্রয়োজন বা তাগিদ অনুভব করেননি। সেই কঠিন সময়টা দিয়েছেন বিভিন্ন প্রকল্পের শিলান্যাস ও উদ্বোধনের রংবাহারি আলোকজ্জ্বল মঞ্চে।

প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, কোনও রকম টেন্ডার ছাড়াই বিজেপি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী জয়সুখভাই প্যাটেলের ওরেভা গ্রুপকে মোরবি সেতু সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অথচ এই কাজে তাদের কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। তারা মূলত ঘড়ি এবং ক্যালকুলেটর তৈরি করে। তাই ব্রিটিশ আমলের তৈরি শতাব্দী প্রাচীন এই সেতুতে মরচের উপর নাম কা ওয়াস্তে রঙের পোঁচ দিয়েই সেরেছে সংস্কারের কাজ এবং ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই খুলে দেওয়া হয় সেতু। তাছাড়া ১২৫ জনের ক্যাপাসিটি থাকা সত্ত্বেও সেদিন ৫০০রও বেশি টিকিট বিক্রি করা হয়েছিল। অর্থাৎ অতিরিক্ত ভিড়ের কারণেই সেদিন ভেঙে পড়েছিল মোরবি সেতু এবং যার জেরে প্রায় ১৫০ মানুষের অকালমৃত্যু হল। শিশুসহ এতগুলো জলজ্যান্ত মানুষ জলে ডুবে মারা গেল। এককথায়, চূড়ান্ত অনিয়ম। প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, তদন্ত করতে সময় লাগবে। অর্থাৎ মাচ্চু নদীর উপর ঝুলন্ত সেতু ভেঙে পড়লেও তদন্ত ঝুলেই থাকবে। কারণ, শিরে সংক্রান্তি গুজরাত বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে কার দোষ বা কার অন্যায় – সে বিচারে না যাওয়াই মঙ্গল। না হলে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চেপে কী যে পরিণতি হবে তার ঠিক নেই। তাই ধীর লয়ে চলুক তদন্ত। যাতে সাপও না মরে, লাঠিও না ভাঙে। অর্থাৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীকে খেপালেও চলবে না, আবার শোকাতুর পরিবারগুলোকে কিছু আর্থিক দাক্ষিণ্য দিয়েই এ যাত্রায় কাজ সেরে নেওয়া হবে।

গুজরাতে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে ওই রাজ্যে দেদার বরাদ্দ হয়। মোচ্ছবও হয় অকাতরে। উন্নয়নের অছিলায় টাকা দেওয়ার জন্য ‘গৌরী সেন’ সদাই উদারহস্ত। তবে ‘গাজর’ ঝোলানো হয় মূলত নির্বাচনের মুখেই। তারই জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয় ভোট ঘোষণা। হিমাচল প্রদেশে নির্বাচন হলেও অকারণে গুজরাটে ভোট পিছিয়ে করা হল ১ ও ৫ ডিসেম্বর। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণা এবং সে সবের শিলান্যাস ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের হিড়িক চলছে। ভোটের আগে কল্পতরু সেজেছেন মোদিজী। তবে, এবার কিছুটা বেসুরো হয়েছে নীতি আয়োগ। কংগ্রেস জমানার যোজনা কমিশনের নাম বদলে ২০১৫ সালে নীতি আয়োগ করেছিলেন মোদিজী। তাঁরই হাতে তৈরি এই আয়োগ মাত্র কদিন আগে ভর্ৎসনা করে কেন্দ্র সরকারকে বলেছে, মুড়ি-মুড়কির মতো প্রকল্প ঘোষণা করে চমক না দিয়ে পূর্বঘোষিত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে সমাধা করা হোক। কেন ৪৯৪টি প্রকল্পের ৫লক্ষ কোটি টাকার কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই শুরু হয়েছে একের পর এক নয়া প্রকল্পের ঘোষণা? অর্থাৎ বাপেরও বাপ আছে, তাই নীতি আয়োগও বিজেপির খেলা ধরে ফেলেছে। তাই বেশি কেরামতি দেখাতে বারণ করেছে কেন্দ্রীয় আর্থিক সংস্থাটি।

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও