সাড়ে তিনশো বছরের পুরানো আদি সেন বাড়ির দুর্গাপুজোয় উমারুপে নয়, মা পুজিত হন মাতৃরুপে, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করেন এক ব্রহ্মদৈত্য!

 

দেবিকা মজুমদার

১২১৯ বঙ্গাব্দে শুরু হয়েছিল মাটিয়ারি বা পূর্বের মোতিহারির আদি সেন বাড়ির দুর্গাপূজো। বাড়ির এক পূর্বপুরুষ শম্ভুনাথ সেনের হাত ধরে প্রচলন হয় এই দুর্গা পুজোর। আর, এই পুজোর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এক বেল গাছের ইতিহাস। বাড়ির বাসিন্দাদের এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস ওই বেলগাছেই বাস করেন এক ব্রহ্মদৈত্য। বিভিন্ন সময়ে এই বাড়ির বাসিন্দারা দেখেছেন তাঁকে বা শুনেছেন তাঁর পদশব্দ। শুধু তাই নয়, এবাড়ির বাসিন্দাদের বিশ্বাস, দেবী দুর্গা নিজেও রাতে হেঁটে বেড়ান এবাড়ির দালানে। বহুবার, শোনা গিয়েছে তাঁর হাঁটার শব্দ। সেন বাড়ির মতে, এই বাড়ি মায়ের। তাই, মা এখানে কন্যারুপে বা উমারুপে নন, মাতৃরুপেই পুজিতা হন।
বাড়ির বর্তমান এক বরিষ্ঠ সদস্য অমিত কুমার সেন জানান, বাংলাদেশের যশোর থেকে যখন তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এদেশে এসেছিলেন তখন তাঁদের সাথেই এসেছিল এই পূজাও। সেসময়, মাটিয়ারিতে নয়, পূজা হত দাঁইহাটে। পরে, ব্যবসার কারণে মাটিয়ারিতে পরিবারের লোকেরা চলে এলে একটু একটু করে গড়ে ওঠে মাটিয়ারির আজকের আদি সেন বাড়ি। তাঁর ঠাম্মার কথা মনে করে তিনি বলেন, এই পুজা যখন শুরু হয়, তখন হিন্দু রীতি মেনে বাড়ির সংলগ্ন উঠানে লাগানো হয়েছিল বেলগাছ। কারণ, বেলগাছ মানেই ধরে নেওয়া হয় শিবের প্রতীক। তাই, এই পুজার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এই বেল গাছের ইতিহাস।
অমিত কুমার সেন এপ্রসঙ্গে নিজের ছোটবেলার কিছু ঘটনা মনে করে হিন্দুস্থান গেজেটকে বলেন, তাঁর ছোটবেলায় তাঁদের পড়ার ঘর ছিল আজকের ঠাকুর দালানের ঠিক পাশের একটি ঘরে। সন্ধ্যেবেলা সেঘর থেকে বেরনোর আগে, তাঁদের ঠাকুমা তাঁদের বলতেন হাতে তালি দিয়ে তারপর ঘর থেকে বেরোতে। শুধু তাই নয়, মুখে বলতে হত, “যদি, আপনারা কেউ থাকেন, আপনারা সরে যান, আমরা আসছি”। অমিত বাবুর ভাষায়, কোনোভাবেই তাঁদের বিরক্ত না করাই রীতি ছিল। শুধু তাই নয়, ছোটবেলায় মাঝেমাঝেই রাতের বেলায় শুনতে পেতেন ঠাকুর দালান থেকে কাঁসর, ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। তাঁর ঠাকুমা বলতেন, কিছু ভয় পাস না। যাদের পুজা করার তারা পুজা করছে। শুধু তাই নয়, অমিতবাবু জানান, একবার ওই বেল গাছে ভোরবেলা হর-গৌরীকে বসে থাকতেও দেখেছেন তাঁর ঠাম্মা।
বর্তমানে বেহালার বাসিন্দা এবাড়ির অপর এক সদস্য দেবায়ন সেনের মতে, এই সেন বাড়িকে এবং এর বাসিন্দাদের সমস্ত রকম বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন মা নিজে এবং আজও বাড়ির তত্বাবধান করেন তিন শতাব্দী প্রাচীন বেলগাছের বাসিন্দা ব্রহ্মদৈত্য। শুধু তাই নয়, বাড়ির যে অংশে বেল গাছটি আছে, সেই অংশটি সবসময় পরিস্কার রাখা হয়। কারণ, মনে করা হয়, ওই অংশে কোনও নোংরা, আবর্জনা পড়ে থাকলে কুপিত হবেন ব্রহ্মদৈত্য। বর্তমানে এবাড়ির কোনও সদস্য-ই এবাড়িতে না থাকলেও পুজার সময় সবাই চলে আসেন বাড়ির পুজায় অংশগ্রহণ করতে এবং এখনও ব্রহ্মদৈত্য যে পথ দিয়ে হাঁটেন সেই পথে কোনও বাধা রাখা হয় না। এমনকি, একপাটি চটিও নয়।
তবে, এই বাড়ির পূজা শুধুমাত্র ব্রহ্মদৈত্য বা মায়ের সদা জাগ্রত অস্তিত্বের জন্য বিশেষ নয়। বিশেষ এখানের পুজার রীতিও। শাক্তমতে দেবীর পুজা হলেও তাঁর মধ্যে মিশে গিয়েছে বৈষ্ণব আচার। তাই, অষ্টমীর দিন সন্ধি পুজায় মায়ের সামনে কোনও জীবিত প্রাণী নয়, বলি দেওয়া হয়, চালকুমড়ো। দেবায়ন সেন জানিয়েছেন, এবাড়ির পুজায় ঢাক বাজানো হয়না। বাজানো হয় ঢোল এবং সানাই। বংশ পরম্পরায় ধরে যারা ঢোল, সানাই বাজিয়ে আসছেন তাঁরাই আজও বাজিয়ে চলেছেন। শুধু তাই নয়, দেবায়ন জানিয়েছেন, এই বাড়ির পুজায় অষ্টমীর দিন রীতি অনুযায়ী,সন্ধি পূজার সময়, দুই হাতে এবং মাথায় ধুনো জ্বালিয়ে সংকল্প করেন বাড়ির কোনও বিবাহিত মহিলা। এর কারণ হিসাবে দেবায়নের স্ত্রী জানান, বাম হাতে ইরা, ডান হাতে পিঙ্গলা এবং মাথায় সুষুম্না এই তিন নারীর যোগসাধনে সংকল্প সিদ্ধির উদ্দেশ্যে ধুনো পোড়ানো হয়।
দেবায়ন জানান, অষ্টমীর সন্ধি পুজায় জ্বালানো হয়, একশো আটটি প্রদীপ। নবমীর দিন আয়োজন করা হয় কুমারি পুজার। খাওয়ানো হয় বাড়ির আশেপাশের বাসিন্দাদের। এছাড়া, রীতি মেনে দশমীর সকালে বেলপাতায় দুর্গা সহায় লেখা হয় এবং সারিবদ্ধভাবে, ঠাকুর দালান থেকে বাড়ির মহিলা এবং পুরুষেরা পুজার ঘট সহ পুজার অন্যান্য সামগ্রী লক্ষ্মীর ঘরে(আগের ঠাকুর ঘর) রেখে আসেন।
দেবায়ন আরও জানান, আগে পুজার সময়, ঠাকুর দালানে বসত যাত্রা পালার আসর। তবে, এখন আর সেসব হয় না। তাঁর ছোটবেলা থেকে তিনি দেখেননি। তিনি আরও বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর কাছে এবং তাঁর বাড়ির বাকি সদস্যদের কাছে দুর্গা পুজা মানেই বাড়ির দুর্গা পুজা। কলকাতার দুর্গা পুজা কেমন হয় তা কোনোদিন তিনি নিজে ঘুরে দেখেন নি। তাঁদের কাছে দুর্গা পূজা মানেই মাটিয়ারির বাড়িতে ফিরে আসা এবং বাড়ির সব সদস্য মিলে একসাথে পুজার আনন্দে মেতে ওঠা। তাঁর কাছে বছরের শুরু এবং শেষ হয় এই পুজার সঙ্গেই।
দেবায়নের স্ত্রী জানান, বিয়ে করে আসার পর থেকে এক অদ্ভূত আত্মার সম্পর্ক অনুভব করেন তিনি এই বাড়ির সঙ্গে। তাঁর ভাষায়, কোথাও বেড়াতে গেলেই, শেষের দিকে মনটা “বাড়ী যাবো, বাড়ী যাবো” করতে থাকে। অথচ, এই বাড়িতে আসতে তেমন মনেই হয়নি। বারবার মনে হয়েছে, এটাই বাড়ী, এখানে যেন আমি দিনের পর দিন থাকতে পারি শুধুমাত্র টানের খাতিরে। যখন প্রথম বাইরে থেকে গেটের ভেতর চেয়ে দেখি, মনে হয় এই মাটিয়ারির সেন বাড়িটা এমনভাবে তার কড়িকাঠ, ইঁট, লাল মেঝে, সবুজ দেওয়াল, শিক দেওয়া জানলা গুলো নিয়ে বছরের পর বছর এই দিনগুলোর জন্যে আকুল অপেক্ষা করে রয়েছে। যেন, অনেকদিন পর দূরের কোনও শহর থেকে বাড়ি ফিরবো বলে মা রান্না করে, ঘর গুছিয়ে বসে আছে। আমার খালি মনে হয়, এই বাড়ি, এই দালান, এই গাছগাছালি হয়তো আকাশগঙ্গা সাজানোর প্রথম দিন থেকেই এখানে ছিল। ঠাকুরদালানের প্রদীপ নিরন্তর জ্বলে আছে সেইদিন থেকেই, কখনো নেভেনি। আমার খালি মনে হয় এই ঘরগুলো, এই বারান্দা, এই ছাদের আবহাওয়ায় কান পাতলেই মহালয়ার তর্পণ সম্পূর্ণ হয়ে যায়। বিসর্জনের পর সবার মন খারাপ হয়ে যায়, আমার হয় না। আমি খুব ঘনঘন আমার শহর, আমার ঘর বদলেছি বলে, কোনো সমাপ্তিই আমাকে তেমন বিচলিত করতে পারে না। আমি জানি যে সবকিছু শেষ হয়, আবার শুরু হবে বলে। পরের শরতে আমরা আবার বাক্স গোছাবো, আবার ক্যালেন্ডার-তিথি-নক্ষত্র দেখবো বাড়ী ফেরার জন্য। আমাদের মনে ততদিন অবিচল থাক গয়না পরানো, বোধন, আরতি, পদ্ম ফোটানো, বেলপাতা লেখার স্মৃতি। ততদিন অবধি অবিরাম জ্বলতে থাক ঠাকুরদালানের প্রদীপ।

সর্বশেষ সংবাদ

জনপ্রিয় গল্প

সর্বশেষ ভিডিও